বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা — প্রতিটি মানুষই আত্ন-অনুসন্ধান করে। সে তার জাতিগোষ্ঠী জাতিসত্তার পরিচয় নিয়ে অন্য জাতির কাছে স্বাধীনভাবে বাচতে চায়। আমরা বাঙালী জাতি, আমাদের মুখের ভাষা বাংলা। আমরা বাংলাদেশে বসবাস করি। অন্যান্য সব জাতির মতো আমাদেরও আছে গৌরবময় ইতিহাস, আত্বনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, অধিকার আদায়ে বুকের তাজা রক্ত দেয়ার ইতিহাস, বিজয় ছিনিয়ে আনার ইতিহাস। প্রিয় পাঠক, আজকের এই পোস্টে আমরা বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা বা বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা নিয়ে কথা বলবো।
বাংলাদেশের ইতিহাস - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা
ইতিহাস শব্দটির উৎপত্তি ‘ইতিহ’ শব্দ থেকে। যার আভিধানিক অর্থ “ঐতিহ্য”। ঐতিহ্য হচ্ছে অতীতের অভ্যাস, শিক্ষা, ভাষা, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি যা ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত থাকে। এই ঐতিহ্যকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয় ইতিহাস। বর্তমানের সকল বিষয় অতীতের ক্রমবিবর্তন ও অতীত ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
আর অতীতের ক্রমবিবর্তন ও ঐতিহ্যের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণই হল ইতিহাস। তবে এখন বর্তমান সময়েরও ইতিহাস লেখা হয় যাকে বলে সাম্প্রতিক ইতিহাস। সুতরাং ইতিহাসের পরিসর সুদূর অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের ইতিহাস বলতে বাংলাদেশের সূচনা, জন্ম বা উৎপত্তিকে বোঝায়। আজ আমরা ও নতুন প্রজন্ম যেভাবে স্বাধীনভাবে বসবাস, সাবলীল ও বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি তা এমনি এমনি সহজভাবে আমাদের কাছে আসেনি।
বরং লাখো লাখো মানুষের জীবন দিয়ে আমাদের আনতে হয়েছে। প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম হয়েছে নতুন স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের সেরা কীটনাশক কোম্পানির তালিকা
প্রাচীন বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস (৩২৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ)
মৌর্য ও গুপ্ত যুগে বাংলা
গুপ্ত যুগের পূর্বে প্রাচীন বাংলার ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করার তেমন কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি।কেননা তখনকার মানুষ আজকের মতো ইতিহাস লেখায় অভ্যস্ত ছিলনা। ভারতীয় ও বিদেশী সাহিত্যে এ সময়কার বাংলা সম্পর্কে ইতস্তত ও বিক্ষিপ্ত উক্তি থেকে আমরা ইতিহাসের অল্প সল্প উপাদান পাই। এসকল বিচ্ছিন্ন ঘটনার জোড়াতালি দিয়ে সন তারিখ ও প্রকৃত ঘটনার সংবলিত ধারাবাহিক কোনো ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়।
বস্তুত ৩২৭-২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় থেকে প্রকৃত ইতিহাস পাওয়া যায়। গ্রিক লেখকদের কথায় তখন বাংলাদেশ ‘গঙ্গারিডই’ নামে এক শক্তিশালী রাজ্য ছিল গঙ্গা নদীর যে দুটি স্রোত এখন ভাগীরথী ও পদ্মা বলে পরিচিত উভয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলে গঙ্গারিডই জাতির অবস্থান ছিল। গ্রিক গ্রন্থাগারগন “গঙ্গারিডই” ছাড়াও ‘প্রাসিঅয়’ নামে অপর এক জাতের উল্লেখ করেছেন। তাদের রাজধানীর নাম ছিল পালিবোথরা।
গ্রিক লেখকদের বর্ণনার উপর নির্ভর করে অনুমান করা যেতে পারে যে এজাতি একই রাজবংশের নেতৃত্বে একসঙ্গে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলো। অনুমান করা যেতে পারে আলেকজান্ডারের আক্রমণের সময় বাংলার রাজা মহাদেশ জয় করে পাঞ্জাব পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। তিনি ছিলেন পালিবোথরা নন্দ বংশের কোন রাজা। আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের মাত্র দুই বছর পর ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভারতের এক বিশাল অঞ্চলের ওপর মৌর্য বংশের প্রভুত্ব স্থাপন করে। উত্তর বাংলায় মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
অশোকের রাজত্বকাল অঞ্চলটি মৌর্যদের একটি প্রদেশে পরিণত হয়েছিল। প্রাচীন পুন্ড্রনগর এ প্রদেশের রাজধানী। উত্তরবঙ্গ ছাড়াও মৌর্য শাসন কর্ণসুবর্ণ (মুর্শিদাবাদ), তাম্রলিপ্ত (হুগলি) ও সমতট (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ‘শুঙ্গ’ ও পরে ‘কম্ব’ বংশের আবির্ভাব ঘটে। ধারণা করা হয়, তারা কিছু অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থার প্রচলন করেছিল। তাদের পতনের পর আবির্ভাব হয় গুপ্ত সাম্রাজ্য।
পঞ্চম শতকে দুগ্ধ পাহাড়ে জাতি কোনো ষষ্ঠ শতকে মানবের যশোবর্মন এর আক্রমণের ফলে ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধে গুপ্ত শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের দূর্বলতার সুযোগে বঙ্গ জনপদ একটি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর সারা উত্তর ভারতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজবংশের উদ্ভব হয়। এরপর ধীরে ধীরে শাসন প্রচেষ্টা এর ধারাবাহিকতায় স্বাধীন গৌড় রাজ্য মাৎস্যন্যায় ও পাল বংশ (৭৫০-১১৬১), সেন বংশ (১০৬১-১২০৪) এদের পর থেকেই বিভিন্ন ধরনের জাতি বিভিন্ন সময় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের সেরা সিমেন্ট ২০২২
প্রাচীন বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস:
প্রাচীন বাংলার সামাজিক জীবন
প্রাচীন বাংলার সামাজিক জীবন ছিল খুবই দুষ্কর। এ সময়ে সমাজ বিভিন্ন ধরনের গোত্রে বিভক্ত ছিল।আর্যপূর্ব কিছু কিছু ধর্মচিন্তা বা দর্শন পরবর্তী সময়ে এদেশের হিন্দু ধর্মের ছড়িয়ে পড়ে। যেমন-কর্মফল জন্মান্তরবাদ, যোগ-সাধনা ইত্যাদি। তখনকার বাঙালি মেয়েদের গুনাবলি ছিল সুখ্যাতি। মেয়েরা লেখাপড়া শিখতেো। একটি বিবাহ ছিল সমাজের নিয়ম। তবে পুরুষেরা বহু রাখতে পারতো।
বিধবাকে শুধুমাত্র নিরামিষ আহার করে সব ধরনের বিলাসিতা ত্যাগ করা হতো। স্বামীর মৃ- ত্যু হলে স্ত্রীকে ও মৃ- ত স্বামীর চিতায় সহমরণে যেতে হতো। এ প্রথাকে বলা হত সতীদাহ প্রথা। সম্পত্তিতেনারীদের কোন আইনগত অধিকার ছিলনা। বাংলার প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে বাঙালির উন্নতচরিত্র কথা জানা যায়। কিন্তু তাই বলে বাঙালির সামাজিক জীবনে কোনো রূপ দুর্নীতি বা অশ্লীলতা ছিলনা এমন কথা বলা যায়না।
প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা
বাংলা চিরকালের কৃষি প্রধান দেশ প্রাচীনকালের অধিকাংশ মানুষ এই গ্রামে বাস করত। আর গ্রামের আশেপাশে ভূমি চাষ করে সংসার চালাতো। তাই এদেশের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে কৃষির উপর নির্ভর করে। ধান ছিল বাংলার প্রধান ফসল। এছাড়াও পাঠ, ইক্ষু, তুলা, নীল, সরিষা ও পান চাষের জন্য বাংলার খ্যাতি ছিল।
আরো পড়ুনঃ থার্টি ফার্স্ট নাইট এর ইতিহাস
প্রাচীন বাংলার আচার অনুষ্ঠান ও উৎসব এর রীতি নীতি
প্রাচীন বাংলার পূজা-পার্বণ আমোদ-প্রমোদের প্রচুর ব্যবস্থা ছিল। উমা, বিজয় দশমী, হোলাকা বর্তমানকালে হোলি নামে পরিচিত প্রভূতি দিনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের উৎসব পালন করা হতো।এছাড়াও বিয়েতে গায়ে হলুদের প্রচলন হিন্দু সম্প্রদায় শুরু করে। বাংলার প্রাচীন ধর্ম শাস্ত্রের নৈতিক জীবনের খুব উচ্চ আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায়। একদিকে সত্য, দয়া, দান, শৌচ প্রভূতিকে ভালো অপরদিকে আত্মহত্যা, সুরা পান, চুরি করা, পরদান গমন ইত্যাদিকে অন্যায় ও গর্হিত কাজ বলে বিবেচিত করা হতো।
মধ্য যুগের শাসন ব্যবস্থা (১২০৪ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ)
মুসলমান শাসনের সূচনা কালকে বাংলার মধ্যযুগের সময় বলা হয়। ইতিহাসে এক যুগ থেকে অন্য যুগে প্রবেশ করতে হলে বিশেষ কতকগুলো যুগান্তকারী পরিবর্তন দরকার। মুসলমানদের বঙ্গ বিজয় এর ফলে বঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শুধু পরিবর্তন আসেনি এর ফলে বঙ্গের সমাজ ধর্ম অর্থনীতি ভাষা ও সাহিত্য শিল্পকলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে।
তেরো শতকের শুরুতে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বাংলার উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাংশের সেন শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমান শাসনের সূচনা করে। এ সময় বাংলায় অনেক শাসক বিভিন্ন ধরনের শাসন ব্যবস্থা প্রচলন ঘটায়। এদের মধ্যে কয়েকজন হলেন সুলতান গিয়াস উদ্দিন খলজি, ইলিয়াস শাহী বংশ, হাবসি, হুসেন শাহ, আফগান ও বারো ভূঁইয়া, শায়েস্তা খান, নবাব মুর্শিদকুলি খান সহ আরো অনেকে।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশে জমি কেনার সংক্ষিপ্ত নির্দেশিকা
মধ্যযুগে বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস
মধ্যযুগের বাংলায় সমাজ ব্যবস্থায় হিন্দু ও মুসলমান এই দুইটি ধর্মের প্রভাব বিরাজমান ছিল। বস্তুত এই দুই ধর্মকে কেন্দ্র করেই মধ্যযুগে বাংলার সামাজিক রীতিনীতি গড়ে উঠেছিল। মধ্যযুগে বাংলায় মুসলমান শাসনকালে সুলতান ছিলেন সমাজ জীবনে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। জুমা ও ঈদের নামাজের খুতবা পাঠ মুসলমান শাসকের বিশেষ এক কর্তব্য ছিল। তাকে মুসলমান শাসকের নেতা হিসেবে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হতো। মুসলমানদের ঐক্য ও ধর্মীয় চেতনা প্রসার এর জন্য শাসক নিজ নিজ অঞ্চলে মসজিদ মাদ্রাসা ইত্যাদি নির্মাণ করতেন।
অর্থনৈতিক অবস্থা ও ব্যবসা-বাণিজ্য
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এখানকার কৃষি জমির উর্বর। মধ্য যুগে এখানকার উৎপন্ন ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ধান, গম, ইক্ষু, পাট, আদা, জোয়ার, সরিষা ও ডাল। কৃষিজাত দ্রব্য দ্রব্যের মধ্যে পিয়াজ, রসুন, হলুদ, শসা প্রভৃতি। আম, কাঁঠাল, কলা, মোসাব্বর,খেজুর ইত্যাদি ফলমূলের ফলনো ছিল প্রচুর। পান, সুপারি, নারিকেল প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হতো।
গালা বা দ্রাক্ষা উৎপন্ন হতো প্রচুর। মুসলমান শাসনের সময় থেকে বাংলায় পাথরের সমাচার শুরু হয়। এছাড়াও মুসলমানদের শাসন কালে বঙ্গে বস্ত্রশিল্প,চিনিশিল্প,নৌকা নির্মাণ,কারখানা ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল। বাংলা ক্ষুদ্র শিল্পে বাঙালি কারিগরেরা স্বর্ণ-রৌপ্য প্রঞ্জক কাঠ পাথর গজদন্ত ইত্যাদি বিশেষ নিপুণতার সঙ্গে সম্পাদন করত।
এছাড়াও তৎকালীন সময়ে বাঙালি রপ্তানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সুতি কাপড় মসলিন রেশনের চাল চিনি গুঁড়া আদা লংকা ইত্যাদি। মুসলমান শাসনের সময় বাংলায় বেশকিছু সমুদ্র বন্দর ও নদী বন্দর গড়ে উঠেছিল। এসব বন্দরে শুধু রপ্তানি নয় বরং বেশ কিছু পণ্য সামগ্রী যেমন- স্বর্ণ-রৌপ্য, মূল্যবান পাথর আমদানি করা হতো।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের সেরা ১০ ঔষধ কোম্পানি ২০২২
ইংরেজ শাসন আমলে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন
বাঙালিরা কখনোই বিদেশি ইংরেজি শাসকদের মেনে নিতে পারেনি। ফলে পলাশী যুদ্ধের পর পরই এদেশে ব্রিটিশবিরোধী নানা বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। পরাধীনতার ১০০ বছর পর স্বাধীনতা ঘোষণা করে এদেশের সৈনিকরাও দেশীয় রাজারা। পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত তরুন সমাজ। বাঙালি তরুণ সমাজ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দলে দলে আত্মাহুতি দিয়েছেন কাঁপিয়ে তোলে ইংরেজ শাসনের ভীত। উপমহাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সবচেয়ে গৌরবময় ভূমিকা ছিল বাঙ্গালীদের। এটি ইতিহাসের পাতায় ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বঙ্গভঙ্গ(১৯০৫ থেকে ১৯১৮ সাল)
বাংলা রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি নষ্ট হয়ে যায়। একে অপরকে শত্রু ভাবতে শুরু করে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস বৃদ্ধি পেতে থাকে। নেতাদের উদার প্রচেষ্টা যৌথ রাজনৈতিক কর্মসূচির ফলে মাঝে মাঝে ঐক্যের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলেও শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ বিভেদ নীতি উদয় হয়।
উল্লেখ্য, উপনিবেশগুলোতে ব্রিটেনের ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ এই নীতি অনুসরণ করতো। পরিণতিতে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের ভাগ হয়। জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি নতুন রাষ্ট্রের। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ব্যর্থ হলে কংগ্রেসের উগ্রপন্থী অংশের নেতৃত্বে স্বদেশী আন্দোলন হয়। এ আন্দোলনের মূল কর্মসূচী ছিল দুইটি- বয়কট ও স্বদেশী।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের সেরা ১০ কোম্পানি ২০২২
খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন
হিন্দু ও মুসলমানের মিলিত সংগ্রামে হিসেবে উপমহাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আন্দোলন দুটি ছিল ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম ব্যাপক ও জাতীয়ভিত্তিক গণআন্দোলন। হিন্দু-মুসলমানের এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভীত কাঁপিয়ে দেয়। তুরস্কের খলিফার মর্যাদা ও তুরস্কের অখন্ডতা রক্ষার জন্য ভারতীয় মুসলিম সমাজে আন্দোলন গড়ে তোলে।
অপরদিকে অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের জন্য স্বরাজ্য অর্জন। ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধী এই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এরপর বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন (১৯১১ থেকে ১৯৩০) হয়। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার যে গোপন তৎপরতার সূত্রপাত ঘটে তাকেই বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন বলা হয়ে থাকে।
ভাষা আন্দোলনের ও পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ
১৯৪৭ সালের দ্বিজাতি তত্বের ওপর ভিত্তি করে ভারত উপমহাদেশের ভাগ হয়ে পাকিস্তান এবং ভারত নামে দুটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তৎকালীন পূর্ব বাংলার পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হাওয়ায় পরবর্তীকালে এর নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালে দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ৫৬ ভাগ বাংলা ভাষী এবং শতকরা ৩.২৭ ছিল উর্দুভাষী। তবুও শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ প্রথমেই প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠেন। তারা এই অন্যায় ও বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। তরুণ নেতা শেখ মুজিবসহ অন্যান্য ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দ এর প্রতিবাদ জানান। এভাবেই পূর্ববাংলায় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। ১৯৫২ সালে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম গ্রেফতার হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
এ সময় আরো গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শামসুল হক, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুবসহ অনেকেই। ভাষার জন্য প্রতিবাদী আন্দোলন এ পৃথিবীতে প্রথম শহীদ হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউর সহ অনেকেই। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই দীর্ঘ সময়ে বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পটভূমি রচনা করেছিল ভাষা আন্দোলন। এই ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার উদ্দীপ্ত করে।
আরো পড়ুনঃ অলিম্পিক গেমসের সম্পূর্ণ ইতিহাস
রাজনৈতিক তৎপরতা ও স্বাধীনতা অর্জন
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পরেই নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নতুন নামকরণ হয় পাকিস্তান মুসলিম লীগ। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসক দল হিসেবে মুসলিম লীগ এর যাত্রা শুরু হয়। শুরু থেকে উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবর্গের পকেট দলে পরিণত হয় মুসলিম লীগ। পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে বাঙালি নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টা উদ্যোগ ও আত্মত্যাগ ভুলে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলিম লীগ নেতারা বাঙালির বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে বাঙালির প্রতি চালায় দমননীতি।
পরবর্তীতে এই মুসলিম লীগের উপেক্ষিত মহান নেতা সমূহ সকলে মিলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দল প্রতিষ্ঠা করেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনা কে প্রাধান্য দিয়ে ১৯৫৫ সালে এই রাজনৈতিক দলটির নাম মুসলিম শব্দটি কেটে আওয়ামী লীগ রাখা হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। যুক্তফ্রন্টের বাঙালি পক্ষে ২১ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৬ সালে দেশ পরিচালনার জন্য সংবিধান প্রণয়ন করা হয়।
এই সংবিধানে পূর্ব বাংলার সাধারন মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। তারা এই সংবিধানের পরিবর্তন চায়। ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তান এর লোকজন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, সামরিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভেদ সৃষ্টি করে। ১৯৬৬ সালে বাঙ্গালীদের পক্ষ থেকে ছয় দফা আন্দোলন করা হয়।১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ঘটে। এভাবে আন্দোলনকারীরা জোরালো হতে থাকে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা।
আরো পড়ুনঃ ফিলিস্তিন ও ইসরাইল যুদ্ধের কারণ
বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা
মিশরীয় সভ্যতা
আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর পূর্ব অংশে অবস্থিত দেশটির নাম ইজিপ্ট মিশর। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ১২০০ অব্দ পর্যন্ত নীল নদের অববাহিকায় একটি সমৃদ্ধ জনপদ এর উদ্ভব হয়। এ সময় থেকে মিশর প্রাচীন সভ্যতায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করে। যেমন ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে প্রথম রাজবংশের শাসন আমল শুরু হয়। এ সময় থেকে মিশরের ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। একই সময়ে নারমার বা মেনেস হন একাধারে মিশরের প্রথম নরপতি এবং পুরোহিত। তিনি প্রথম ফারাওয়ের মর্যাদা লাভ করেন এরপর থেকে ফারাওদের অধীনে মিশর প্রাচীন বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতিতে একের পর এক উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হন।
সিন্ধু সভ্যতা
সিন্ধু নদের অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল বলে এই সভ্যতার নাম রাখা হয়। সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার সংস্কৃতিকে অনেক সময়ে হরপ্পা সংস্কৃতি বা হরপ্পা সভ্যতা বলা হয়ে থাকে। এই সভ্যতার আবিষ্কার কাহিনী চমৎকার। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদারো শহরে উঁচু-নিচু মাটির ঢিবি ছিল। স্থানীয় লোকেরা বলতো মরা মানুষের ঢিবি।
বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পুরাতত্ত্ব বিভাগ এর লোকেরা ওই স্থানে বৌদ্ধ স্তুপ এর ধ্বংসাবশেষ আছে ভেবে মাঠে করতে থাকেন। অপ্রত্যাশিতভাবে বেরিয়ে আসে তাম্র যুগের নিদর্শন। একই সময়ে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে দয়াওরাম সাহানি প্রচেষ্টায় পাঞ্জাবের পশ্চিমদিকে মন্টোগোমারি জেলার হরপ্পা নামক স্থানে ও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। জন মার্শাল এর নেতৃত্বে পুরাতত্ত্ব বিভাগ অনুসন্ধান চালিয়ে আরো বহু নিদর্শন আবিষ্কার করে।
আরো পড়ুনঃ স দিয়ে ছেলেদের ইসলামিক নাম অর্থসহ
গ্রিক সভ্যতা
গ্রিসের মহাকবি হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি মহাকাব্য দুটিতে বর্ণিত চমকপ্রদ’ কাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সত্যকে খুঁজে বের করার অদম্য ইচ্ছা উৎসাহিত করে তোলে প্রত্নতত্ত্ববিদদের। উনিশ শতকের শেষে হোমারের কাহিনী আর কবিতায় তা সীমাবদ্ধ থাকেনা বেরিয়ে আসে এর ভেতরের সঠিক ইতিহাস। ইজিয়ান মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ এবং এশিয়া মাইনরের পশ্চিম উপকূলে আবিষ্কৃত হয় উন্নত এক প্রাচীন নগর সভ্যতা। সন্ধান মেলে মহাকাব্যের ট্রয় নগরী সহ ১০০ নগরীর ধ্বংসস্তূপের। যাকে বলা হয় ইজিয়ান সভ্যতা বা ক্লাসিকাল গ্রিক সভ্যতা। ক্রিট দ্বীপ, গ্রীস উপদ্বীপের মূল ভূখণ্ড এই সভ্যতার অধিবাসীরা ছিল সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের অধিকারী।
রোমান সভ্যতা
গ্রিসের সভ্যতার অবসান এর আগেই ইতালিতে তাইবার নদীতে তীরে একটি বিশাল সাম্রাজ্য ও সভ্যতা গড়ে ওঠে। রোম কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা রোমান সভ্যতা নামে পরিচিত। প্রথমদিকে রোম একজন রাজার শাসনাধীন ছিল। এসময় একটি সভা ও সিনেট ছিল। রাজা স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ৫১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ রোমে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রোমান সভ্যতা প্রায় ৬০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। তাই ইতিহাসের পাতায় বিরাট এক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বহন কর। প্রিয় পাঠক আমাদের আজকের এই বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা আর্টিকেলটি আপনার কেমন লেগেছে অবশ্যই কমেন্ট করে জানিয়ে দিবেন।
আরো পড়ুনঃ বেতন বৃদ্ধির জন্য আবেদন
আর্টিকেল সম্পর্কিত তথ্য জানতে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।