ফজরের নামাজের সময় - ফজরের নামাজের শেষ সময় - ফজরের নামাজের ফজিলত — আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের জন্য, তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত হাদিয়া স্বরূপ দিয়েছেন। সালাত হচ্ছে এমন এক মাধ্যম যার দ্বারা বান্দারা আল্লাহ সুবহানা তায়ালার সবচেয়ে নিকটবর্তী থাকে।
সালাত আদায় রত অবস্থায় বান্দা ও তার রবের মাঝে কোন পর্দা থাকে না। এই পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের জন্য পাঁচটি ভিন্ন সময়ে আল্লাহ তায়ালার নির্ধারণ করে দিয়েছেন; যেন বান্দা তাঁর ইবাদত করতে গিয়ে ক্লান্তি ও একঘেয়েমিতে না পরে। আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআনুল কারীমে নামাজের ব্যাপারে অনেকবার বলা হয়েছে।
এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হচ্ছে মুমিন বান্দাদের জন্য নেয়ামত স্বরূপ শ্রেষ্ঠ হাদিয়া তার রবের পক্ষ থেকে। তার মধ্যে একটি ওয়াক্ত হচ্ছে ফজরের ওয়াক্ত। ফজরের পরের বাতাস মুনাফিকদের নিঃশ্বাস থেকে মুক্ত। সুবহে সাদিকের সময় ফজরের সালাতের ওয়াক্ত শুরু হয়, এ সময় অনেকেরই ফজরের সালাত আদায় করা বাদ পড়ে যায় ঘুমের কারণে তাই আজ আমরা ফজরের সালাতের সময় এবং ফজরের সালাতের শেষ সময় সম্পর্কে জানব। ফজরের সালাতের যে ফজিলত গুলো আছে সেই সম্পর্কেও অবহিত হবো।
আরো পড়ুনঃ কিভাবে বুঝব দোয়া কবুল হয়েছে
ফজরের সালাতের সময় - ফজরের নামাজের ওয়াক্ত
সুবহে সাদিক হওয়ার সাথে সাথে এবং সূর্য উদয়ের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সময় হচ্ছে ফজরের সালাতের সময়। রাতের শেষে আকাশের পূর্ব দিগন্তে লম্বা আকৃতির যে আলোর রেখা দেখা যায় তাকেই বলে সুবহে সাদিক। কিছু হাদিসের উপর দৃষ্টিপাত করলে ফজর এর সালাতের সঠিক সময় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
আবূ গাসসান মিসমাঈ ও মুহাম্মাদ ইবনু মূসান্না রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, আবদুল্লাহ ইবনু আমর রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা যখন ফজরের সালাত আদায় করবে, সেটাই ফজরের ওয়াক্ত, যতক্ষণ না সূর্যের উপরাংশ উদিত হয়। (সহীহ মুসলিম - ১২৬১)
সাধারণ ভাষায় যদি বলতে হয় তাহলে বলা চলে তাহাজ্জুদ ও সেহরির সময় শেষ হবার পর থেকে ফজর এর সালাতের সময় শুরু হয়। এ সময় আকাশ কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। আয়িশা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন সময় ফজরের নামায পড়তেন যে, মহিলারা চাঁদর গায়ে দিয়ে প্রত্যাবর্তন করত এবং অন্ধকারের কারণে তাদের চেনা যেত না। (সুনানে আবু দাউদ -৪২৩, বুখারী, মুসলিম, ইবনু মাজাহ, নাসাঈ, তিরমিযী)।
আরো পড়ুনঃ কোন নামাজ কত রাকাত
ফজরের সালাতের শেষ সময়
সূর্য উদয় হওয়ার সাথে সাথে ফজরের ওয়াক্ত শেষ হয়, যা সালাতের নিষিদ্ধ সময় গুলোর মধ্যে একটি। আহমাদ ইবনু ইবরাহীম আদ-দাওরাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি, আবদুল্লাহ ইবনু আমর রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'এবং ফজরের ওয়াক্ত থাকে ঊষার উদয়কাল হতে সূর্যদয় না হওয়া পর্যন্ত। আর যখন সূর্য উদয় হতে থাকে তখন সালাত থেকে বিরত থাকবে। কেননা, সূর্য শয়তানের দুই শিংয়ের মধ্য দিয়ে উদিত হয়'। (সহীহ মুসলিম - ১২৬৪)
তবে সূর্য পুরোপুরি উদিত হওয়ার পর ও ফজরের সালাত আদায় করা যায়। এছাড়া বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক নামাজের স্থায়ী ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়েছে যারা কুরআন ও হাদিস এর বর্ণনা অনুযায়ী নামাজের সময় চিহ্নিত করতে না পারেন তাদের জন্য এটি খুব উপকৃত একটি সময়সূচী।
ফজরের সালাতের ফজিলত ও গুরুত্ব
আমরা যখন কোন কাজ করি তার বিনিময় যদি খুব ভালো কিছু হয়ে থাকে তাহলে সেই সম্পর্কে জানলে সে কাজের প্রতি আগ্রহ আমাদের আরো অনেকগুণ বেড়ে যায়। তাই ফজরের সালাতের ফজিলত গুলি জেনে সালাত আদায় করলে আমাদের সালাতের প্রতি আগ্রহ আরো বেশি থাকবে। কুরআনুল কারীমের সূরা ফজর নামে একটি সূরা রয়েছে যেখানে ফজরের সালাতের প্রতি শপথ করা হয়েছে। ফজরের সালাত রিজিক বৃদ্ধি করে। নিচে ফজরের সালাতের কিছু ফজিলত ও তাৎপর্য হাদিসের আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। ইনশাআল্লাহ এতে আমরা উপকৃত হব।
১। ফজরের সালাত সুসংবাদ বয়ে নিয়ে আসে কেয়ামত দিবসের জন্য। হযরত সাহল রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, যারা অন্ধকারে বেশি বেশি মসজিদে গমন করিতে থাকে তাদেরকে কেয়ামত দিবসে পূর্ণ নূরের সুসংবাদ দান করো। (তিরমিযী - ২২৩)
২। হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাতে লম্বা সময় দিতেন। আবু বারযা রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভোরের (ফজরের) সালাতে ৬০থেকে ১০০ আয়াত পর্যন্ত পাঠ করতেন। (সহীহ মুসলিম - ৯১৬)
আরো পড়ুনঃ আলহাজ্ব নামের অর্থ কি | আলহাজ্ব মানে কি
৩। ফজরের সালাতে আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, মুনাফিকদের জন্য সবচেয়ে কষ্টকর সালাত হলো এশা ও ফজর। তিনি আরো বলেন যে, তারা যদি জানতো এশা ও ফজরের কি কল্যাণ নিহিত রয়েছে তাহলে তারা হামাগুড়ি দিয়ে হলেও মসজিদে প্রবেশ করত। (সহিহ বুখারী -৫৩৭)
৪। ফজরের সালাত আমাদের জন্য নিয়ে আসে জান্নাতের সুসংবাদ। হুদবা ইবনু হালিদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি দুই শীতের (ফজর ও আসর) সালাত আদায় করবে সে জান্নাতে দাখিল হবে। (সহীহ বুখারী - ৫৪৬)
৫। ফজরের সালাত আমাদের জন্য হতে পারে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের মাধ্যম। মূসা’দ্দাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি. জারীর ইবনু আবদুল্লাহ্ রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ছিলাম। হঠাৎ তিনি পূর্ণিমা রাতের চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, শোন!
এটি যেমন দেখতে পাচ্ছ– তোমাদের প্রতিপালককেও তোমরা তেমনি দেখতে পাবে। তাঁকে দেখতে তোমরা ভিড়ের সম্মুখীন হবে না। কাজেই তোমরা যদি সূর্য উঠার আগের সালাত ও সূর্য ডুবার আগের সালাত আদায়ে সমর্থ হও, তাহলে তাই কর। তারপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেনঃ “সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসার তাসবীহ্ পাঠ করুন।” (৫০ঃ ৩৯)।
৬। কুরআনুল কারীমে ফজরের সালাতের পর তিলাওয়া এর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সূরা বনী ইসরাইলের ৭৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন- (78) أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَى غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآَنَ الْفَجْرِ إِنَّ قُرْآَنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا। “নামায কায়েম কর সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে নিয়ে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং ফজরে কুরআন পড়ারও ব্যবস্থা কর, কারণ ফজরের কুরআন পাঠ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।” (১৭:৭৮)
৭। জিহাদের ময়দানে ও ফজরের দুই রাকাত সুন্নত আদায় করার নির্দেশ করা হয়েছে। আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত হুজুরে কারীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন "শত্রুবাহিনী তোমাদের তারা করলেও তোমরা এই দুই রাকাত (ফজরের সুন্নত)কখনো ত্যাগ করো না। (আবু দাউদ :১২৫৮)
আরো পড়ুনঃ অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল | অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের নিয়ম
৮। ফজরের সালাত আদায় করার মাধ্যমে আল্লাহর জিম্মায় থাকার সৌভাগ্য পাওয়া যায়। নাসর ইবনু আলী আল জাহযামী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, আনাস ইবনু সীরীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি জুনদুব ইবনু আবদুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কে বলতে শুনেছি যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যাক্তি ফজরের সালাত আদায় করল, সে আল্লাহর যিম্মায় রইল। তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর যিম্মার ব্যাপারে তোমাদের কারো কাছে কিছু চান না। এমন হবে না যে, তোমাকে ধরে তিনি আধো মূখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (সহিহ মুসলিম - ১৩৬৮)
৯। ফজরের দুই রাকাত সুন্নতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার কথা বলা হয়েছে। আয়েশা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের (ফরয নামাযের) পূর্বে চার রাকআত ও ফজরের আগে দু’ রাকআত নামায কখনো ত্যাগ করতেন না। (সহিহ বুখারী - ১১৮২)
১০। ফজরের সালাতের মধ্যে নিহিত রয়েছে পৃথিবীর সমস্ত নিয়ামত এর থেকে ও উত্তম প্রতিদান। আয়েশা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ফজরের দু’ রাকআত (সুন্নত) পৃথিবী ও তাতে যা কিছু আছে সবার চেয়ে উত্তম।(সহীহ মুসলিম - ১৫৬১)
১১। দুনিয়ার সমস্ত কিছু থেকে মূল্যবান ফজরের দুই রাকাত সুন্নত সালাত আদায় করা। অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, ঐ দুই রাকআত আমার নিকট দুনিয়ার সবকিছু থেকে অধিক প্রিয়। (সহীহ মুসলিম - ১৫৬২)
১২। ফজরের সালাতের মাধ্যমে পাওয়া যাবে সারা রাত জেগে ইবাদত করার সওয়াব। উসমান ইবনে আফফান রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি জামাআতের সাথে এশার নামায আদায় করল, সে যেন অর্ধেক রাত পর্যন্ত কিয়াম (ইবাদত) করল। আর যে ফজরের নামায জামাআতসহ আদায় করল, সে যেন সারা রাত নামায পড়ল। (মুসলিম ১৫২৩, আবু দাঊদ ৫৫৫)
তাৎপর্য ও ফজিলত জানার মাধ্যমে সে কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও একাগ্রতা আরো বেড়ে যায়। সেই সমস্ত প্রতিদান পাবো ভেবে মন আরো উৎফুল্ল ও খুশি থাকে। সমস্ত হুকুম-আহকাম মেনে আল্লাহ আমাদের সবাই কে ফজরের সালাত যথা সময়ে আদায় করার তৌফিক দান করুক এবং এর উত্তম ফজিলত আমাদের আমল নামায় লিপিবদ্ধ করুক। *ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক হাদিস গ্রন্থ থেকে সমস্ত হাদিস সংগ্রহীত।
আর্টিকেল সম্পর্কিত তথ্য জানতে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।