রমজান সম্পর্কে হাদিস - মাহে রমজান সম্পর্কে হাদিস — আসছে কিছু দিনের মধ্যে রমজান মাস। যাকে বলা হয় গুনাহ মাফের মাস, দোয়া কবুলের মাস। বিশ্বের সকল মুসলিমদের জন্য রহমতের মাস হচ্ছে রমজান মাস, নাজাতের মাসও বলা হয় রমজান মাসকে এবং মাগফিরাতের মাস এই রমজান মাস। রোজা হলো ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি। ইসলামের ভিত্তি ৫টি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং রোজা তার মধ্যে একটি।
এই স্তম্ভগুলি একজন মুমিনের ভিত্তি এবং একজন সত্যিকারের মুসলমানের জন্য অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করা প্রয়োজন। এই ৫টির মধ্যে যেকোনো একটি যদি কেউ অবিশ্বাস করে তবে সে জান্নাতে যাওয়া তো দূরের কথা ইসলাম থেকেই বাহির হয়ে যাবে। আল্লাহর রসূল (সা.) বলেছেন: "ইসলাম পাঁচটি নীতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এবং রমজান মাসে রোজা পালন করা তাদের মধ্যে একটি।" (সহীহ বুখারি: ৮)। প্রিয় পাঠক চলুন রমজান মাসের রোজা সম্পর্কে কিছু মূল্যবান হাদিস জেনে নেই।
রমজানের রোজা ফরজ
প্রত্যেক মুসলমানকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাব কুরআনুল মাজিদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেনঃ “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা পরহেজগার হতে পার।” (সূরা বাকারা ২ঃ ১৮৩)
এইভাবে, আল্লাহ আমাদের শিক্ষা দেন যে রোজা একটি বাধ্যবাধকতা। সকল ফরজ কাজগুলো পূরণ করার মাধ্যমে একজন মুমিন আল্লাহর কাছাকাছি আসতে পারে। নিম্নোক্ত হাদিস থেকেও তা প্রতীয়মান হয়, রাসুল (সাঃ) বলেছেন যে আল্লাহ বলেছেনঃ "সবচেয়ে প্রিয় আমল যা দিয়ে আমার বান্দা আমার নৈকট্য লাভ করে তা হল ফরজ আমল।" (সহীহ বুখারীঃ ৬৫০২)। তাই আমাদেরকে রমজানে রোযার ফরজ পালন করতে হবে যদি আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চাই।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের সেরা ১০ দর্শনীয় স্থান
কুরআন নাযিলের মাস
রমজান সমস্ত মুসলমানদের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই পবিত্র মাসে বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। যেমন আল্লাহ কুরআনে বলেছেনঃ "রমজান মাসে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানবজাতির জন্য হেদায়েত এবং হেদায়েতের জন্য সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং সত্য ও ভুলের মধ্যে মাপকাঠি।" (সূরা বাকারা ২ঃ ১৮৫)
রোজাদারের দুআ প্রত্যাখ্যাত হয়না
রমজান মাসে আল্লাহর পক্ষ থেকে সবচেয়ে উপহারের মধ্যে একটি হল আমাদের দোয়া কবুল হওয়ার সুযোগ। বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন: "তিনজন আছে যাদের দুআ প্রত্যাখ্যান হয় না ১। রমজানে ইফতারের সময় করা দুআ ২। ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ বা নেতা এবং ৩। মজলুমের দুআ (অত্যাচারিত ব্যক্তির দুআ)" (তিরমিযীঃ ৩৫৯৮)।
রমজানে ওমরাহ হজ্জের (ফরজ হজ্জ্বের) সমান
যদি আপনি আর্থিক এবং শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান হয়ে থাকেন, তাহলে এই বরকতময় মাসে আপনার উমরাহ করা উচিত। যেমন আমাদের নবী (সাঃ) বলেছেনঃ "যখন রমজান আসে, তখন ওমরাহ করতে যাও, কেননা রমজানে ওমরাহ হজ্জ্বের (ফরজ হজ্জ্বের) সমতুল্য।" (সহীহ মুসলিমঃ ১২৫৬)
আরো পড়ুনঃ ছেলেদের ইসলামিক নাম অর্থসহ
শাওয়ালের রোজা সহ রমজানের রোজা
রমজানের রোজা ফরজ এবং শাওয়াল মাসে (রমজানের পরে মাস আসে) ছয় দিন রোজা রাখা একটি সুন্নত (ঐচ্ছিক) তবে এই ৬ শাওয়াল রোজার ফজিলত অপরিসীম। নবী (সাঃ) বলেছেন: "যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখবে, তারপর শাওয়াল থেকে আরো ছয়টি রোজা রাখবে, তাহলে তা সারা বছর রোজা রাখার সমান হবে।" (তিরমিযী : ৭৫৯)
রমজানে সেহরী খাওয়া বরকতময়
সাহুর অর্থাৎ সেহরী হল এমন একটি খাবার যা রোজাদার ব্যক্তি রমজানে রোজা শুরু করার আগে সুবহে সাদিকের আগে (ফজরের নামাজ শুরু করার আগে) গ্রহণ করে। রাসুল (সাঃ) এর হাদীসের আলোকে আমাদের রমজানে এই খাবারটি বাদ দেওয়া উচিত নয়: "তোমরা সেহরি খাও কারণ এতে বরকত রয়েছে।" (সহীহ বুখারি: ১৯২৩)
খেজুর বা পানি দিয়ে ইফতারি
ইফতার হল এমন একটি খাবার যা রোজাদার ব্যক্তি রমজান মাসে (মাগরিবের নামাজের সময়) তার রোজা শেষ করে গ্রহণ করে। নিম্নোক্ত হাদিসের আলোকে খেজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নত যাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "যার শুকনো খেজুর আছে, সে যেন তা দিয়ে ইফতার করুক, আর যে না করে সে যেন পানি দিয়ে ইফতার করুক, কারণ পানিই পবিত্র।" (তিরমিযী : ৬৯৪)
আরো পড়ুনঃ তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম
ভ্রমণের সময় রোজা রাখা
কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত অনুসারে ভ্রমণকারী ব্যক্তির জন্য রোজা ফরজ নয়: “সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি (রমজান মাসের প্রথম রাতে) চাঁদ দেখে (অর্থাৎ নিজ বাড়িতে উপস্থিত হয়), সে যেন সেই মাসে রোযা পালন করে এবং যে অসুস্থ বা সফরে থাকে, সে একই সংখ্যায়। [যেসব দিন রোযা পালন করেনি, সেসব দিন অন্য দিন থেকে কাযা করতে হবে। (সূরা বাকারা ২ঃ ১৮৫)
যদিও একজন মুসাফির ব্যক্তি সফরের দিনে তার রোজা বাদ দিতে পারে এবং রমজানের পরে রোজা বাদ দিতে পারে তবে হাদিস অনুসরণ করলে স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে ভ্রমণের সময় সে রোজা রাখতে চায় কিনা তা একজন মুসাফির ব্যক্তির উপর নির্ভর করে। হাদিস অনুসারে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সফরে রোজা রাখার বিষয়ে বলেনঃ "যদি তুমি (ভ্রমণকারী) হও, তবে রোজা রাখ আর ইচ্ছা করলে রোজা রাখো না।" (সহীহ মুসলিম: ১১২১ (ক)
রমজান মাসে তারাবীহ নামায
রমজান মাসে তারাবিহ নামাজ (ইশার নামাজের পরে) রমজানের অন্যতম নিয়ামত এবং এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তারাবীহ নামায সুন্নত (ঐচ্ছিক) এবং একজন মুমিনের জন্য ফরজ (ফরজ) নয়, কিন্তু এর তাৎপর্য ও সওয়াবের কারণে আমাদের পুরো রমজান মাসে এই নামাজ জামাতে আদায় করার চেষ্টা করা উচিত। নবী (সাঃ) বলেছেন: "যে ব্যক্তি ইমামের সাথে কিয়াম (তারাবীর নামায) শেষ না হওয়া পর্যন্ত নামায পড়বে, সে যেন সারা রাত নামায কাটিয়েছে।" (তিরমিযী : ৮০৬)। তাই সারা রাতের নামাজের সওয়াব পেতে চাইলে রমজানে তারাবিহ নামাজ পড়ুন।
রোজার সময় পাপ থেকে বিরত থাকুন
রোজার সময় শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকাই তাকওয়া অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয় বরং রোজাদারের কাছে সকল প্রকার পাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য বাস্তবসম্মত ও আন্তরিক প্রচেষ্টার দাবি রাখে। রাসুল (সাঃ) বলেছেন যে আল্লাহ বলেছেনঃ "যে ব্যক্তি মন্দ ও অজ্ঞতাপূর্ণ কথাবার্তা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা পরিত্যাগ করে না, তার রোযার কোন মূল্য আল্লাহর নেই।" (ইবনে মাজাহঃ ১৬৮৯)
আরো পড়ুনঃ বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম
রমজান মাসের ফজিলত
১। জান্নাতের দরজা খোলা হয়
পুরো রমজান মাসে আল্লাহ জান্নাতের দরজা খুলে দেন এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন। নবী (সাঃ) এরশাদ করেন: "যখন রমজান মাস শুরু হয়, তখন বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শৃঙ্খলিত করা হয়।" (সহীহ বুখারীঃ ১৮৯৯)
২। রোজা মুমিনের ঢাল স্বরূপ
রমজানের রোজা একটি মহান ইবাদত। নবী (সাঃ) এরশাদ করেন: "রোজা মুমিনের জন্য ঢাল স্বরূপ" (সহীহ বুখারি: ১৯০৪)। আল্লাহর মুমিন বান্দাকে জাহান্নামের আগুন থেকে ঢাল হয়ে রক্ষা করবে এই রোযা। (সুবাহান আল্লাহ) আল্লাহ আমাদের রোযা রাখার তৌফিক দান করুন।
৩। ফরজের সওয়াব ৭০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে
রমজান সম্পর্কে একটি দীর্ঘ হাদিসে সালমান ফারসি (রা.) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন: "যে ব্যক্তি একটি ফরজ (ফরজ) করবে, তাকে অন্য যেকোনো সময়ে সত্তরটি ফরযের সওয়াব দেওয়া হবে" (সুবাহানআল্লাহ)। (সহীহ ইবনে খুজাইমাহঃ ১৮৮৭)
৪। রিজিক বৃদ্ধি করা হয়
উপরে উল্লিখিত একই হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন: "এটি সেই মাস যে মাসে একজন সত্যিকারের মুমিনের রিজিক (খাদ্য, অর্থ, ইত্যাদি) বৃদ্ধি পায়"। (সহীহ ইবনে খুজাইমাহঃ ১৮৮৭)
৫। সারা বছরের সকল পাপের কাফফারা
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ "প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্ত নামায এবং এক জুমার নামায থেকে পরের জুমার নামায পর্যন্ত এবং এক রমজান থেকে পরের রমজান পর্যন্ত এর মধ্যে যা কিছু (গুনাহ) আসে তার জন্য কাফফারা হয়ে যায়, যতক্ষণ না কেউ বড় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে।" অর্থাৎ যে ব্যাক্তি রমাজনের সকল রোযা সহীহ ভাবে পালন করবে তার পরবর্তী রমজান পর্যন্ত সেই ব্যাক্তির সকল গুনাহ আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করে দিবেন যদি না সে কোন বড় গুনাহ করে। অর্থাৎ সকল সগিরা গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন। [সহীহ মুসলিম: ২৩৩(গ)] আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিন এবং উপরের হাদিস গুলো অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন আমিন।
আরো পড়ুনঃ