শবে কদরের নামাজের নিয়ম — রোজা এবং তারাবিহ নামাজের পাশাপাশি রমজানের আরেকটি জিনিস যা সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে লায়লাতুল কদর। এটি রমজানের শেষ দশদিনের মধ্যে যেকোনো একটি বরকতময় রাত এবং এই রাতে কৃত প্রতিটি নেক কাজ ও ইবাদত আল্লাহর কাছে কবুল হয়। তাই প্রতিটি মুসলমান এই রাতে নেক আমল করার চেষ্টা করে। ‘শব’ অর্থ রাত, আর আরবি ‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থও রাত বা রজনী। কদর অর্থ সম্মানিত, মহিমান্বিত। সুতরাং লাইলাতুল কদরের অর্থ সম্মানিত রজনী বা মহিমান্বিত রজনী।
আল্লাহ তা’আলা এই রাতের গুরুত্বতা বুঝাতে একটি সম্পূর্ণ সূরা নাযিল করেছেন কুরআনে যার নাম সূরাতুল কদর। আমরা অনেকেই জানি এই রাতের সম্পর্কে আবার অনেকেই জানি না। আজ আমরা রমজান মাসের শ্রেষ্ঠ রাত লায়লাতুল কদর সম্পর্কে আলোচনা করবো। নীম্নে আলোচনা গুলো মুসলমানদেরকে এই বরকতময় রাতের ফজিলত এবং এটিকে আরো ভালোভাবে পালন করার সম্পর্কে কিছু ধারণা দিতে পারবে।
[আরো পড়ুনঃ] শবে বরাতের নামাজের নিয়ম
শবে কদরের গুণাবলী:
লায়লাতুল কদর ইসলামি ক্যালেন্ডারের অন্যতম বরকতময় একটি রাত। ইসলামে এর মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র রাতের সমান অন্য কোনো রাত নেই। এই লায়লাতুল কদরের রাতটি সাধারণত রমজান মাসের শেষ দশ দিনে থাকে এবং এটি বেজোড় রাতে হয়ে থাকে। নিচে বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসের আলোকে লায়লাতুল কদর রাতের কিছু প্রধান ফজিলত তুলে ধরা হলোঃ কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন: "নিশ্চয়ই আমি এটি (কুরআন) নাযিল করেছি কদরের রাতে।" (৯৭ : ০১)
কুরআনের এই আয়াত থেকে এটা আরও স্পষ্ট যে লায়লাতুল কদরের সাথে জড়িত সবচেয়ে বড় ফজিলত হল যে এই রাতে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে কুরআন দান করেছেন। যা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য প্রেরণ করা সবচেয়ে বড় উপহার। অতএব, যদি কোনো মুসলিম আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চায় এই রাতটি তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থপূর্ণ হতে পারে।
[আরো পড়ুনঃ] ২০২২ সালের রোজার ঈদ কত তারিখে
কুরআনের অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ বলেন: “আল-কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম (অর্থাৎ সেই রাতে আল্লাহর ইবাদত করা হাজার মাস, অর্থাৎ ৮৩ বছর চার মাসের চেয়েও উত্তম)।” (৯৭ : ০৩) কুরআনের এই আয়াতে, আল্লাহতায়ালা বলেছেন যে এই রাতে নামাজের সওয়াব বা কার্যকারিতা অবশ্যই হাজার মাসের নামাজের চেয়ে উত্তম। অতএব, প্রতিটি মুসলমানকে এই রাতে যতটা সম্ভব নামায পড়ার চেষ্টা করতে হবে যাতে অগণিত এবং ব্যাপক সওয়াব পাওয়া যায়।
নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর একটি হাদীসে এই রাত সম্পর্কে নিম্নোক্তভাবে বলেছেন: "যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর কাছে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে সালাত কায়েম করবে, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।" (বুখারী) [সুবহানআল্লাহ]
এই হাদিসে আবার লাইলাতুল কদরের মহান ফজিলতের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই হাদিসটি বলে যে এই রাতটি একজন ব্যক্তির পূর্ববর্তী পাপের জন্য ক্ষমা চাওয়ার সর্বোত্তম বিকল্প। একজন মুসলমানকে যা করতে হবে তা হল হৃদয়ে আন্তরিক হওয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। তাই লায়লাতুল কদরকে ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে ভালো ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পাশাপাশি দোয়া কবুলের রাত হিসেবেও মুসলমান রা এই রাতে ইবাদত করতে পারেন।
[আরো পড়ুনঃ] রমজানের সময় সূচি 2022
রাতের জন্য প্রস্তুতি - শবে কদরের রাতে আমাদের করণীয়
উল্লিখিত ফজিলতগুলো স্পষ্ট করে দেয় যে লায়লাতুল কদর সবচেয়ে বরকতময় রাত এবং এটি রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে পাওয়া যায়। এর পবিত্রতা ও মহত্ত্বের কারণে, একজন মুসলমানের এই রাতের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়া এবং এই রাতটি সর্বোত্তম উপায়ে পালন করা অপরিহার্য। তাই এই সর্বশ্রেষ্ঠ রাতটি পেতে যা করবেন তা এবার আলোচনা করবোঃ
ইতিকাফ পালন করুন - রাতে সর্বোত্তম প্রার্থনা করার জন্য একজন মুমিনের জন্য এর থেকে ভালো উপায় আর হতে পারেনা। কেননা বিশ্ব নবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফের মাধ্যমে কাটিয়েছেন। তাই আমাদের সকলের জন্যই রমজানের শেষ দশ দিনে ইতিকাফের সুন্নত পালন করাই উত্তম।
আপনি যখন ইতিকাফে থাকেন, তার মানে হল আপনি পার্থিব জীবনের সমস্ত বিক্ষিপ্ততা ত্যাগ করেছেন এবং দশ দিনের জন্য দুনিয়াবী সকল কাজ থেকে আলাদা হয়ে শুধু মাত্র আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার আশায় ইবাদত করছেন। আপনার একমাত্র মনোযোগ থাকবে দিন ও রাত জুড়ে নামাজ এবং কোরআন তেলাওয়াত।
[আরো পড়ুনঃ] বাংলাদেশের সেরা মসজিদ - বাংলাদেশের সেরা ১০ মসজিদ
মুনাজাত- মুনাজাতের মাধ্যমে বান্দার বন্দেগি এবং আল্লাহর রবুবিয়াতের প্রকাশ ঘটে। বান্দাহ তার প্রভূর কাছে চায়। আল্লাহ তায়ালা এতে ভীষণ খুশি হোন। মহন আল্লাহ তার বান্দার প্রতি এতটাই অনুগ্রহশীল যে, তিনি তার কাছে না চাইলে অসস্তুষ্ট হোন। ‘যে আল্লাহর নিকট কিছু চায়না আল্লাহ তার উপর রাগ করেন’- (তিরমিযি)। ‘দোয়া ইবাদতের মূল”- (আল হাদিস)।’ যার জন্য দোয়ার দরজা খোলা তার জন্য রহমতের দরজাই খোলা রয়েছে’- (তিরমিযি)। কাজেই আমরা কায়মনো বাক্যে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করবো, ক্ষমা চাইবো, রহমত চাইবো, জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাইবো।
শেষ ১০ টি রাতে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করুন- এতে করে অনেক বেশি সওয়াব পেতে পারবেন। কেননা রমজান মাসে কুরআন তিলাওয়াত করলে প্রতিটি হরফের জন্য ১০ টি নেকি পাওয়া যায়। আর সর্বত্তম ইবাদত হলো কুরান বুঝে পড়া এবং সে অনুযায়ী আমল করা।
জিকির ও দোয়া- হাদিসে যে দোয়া এবং জিকিরের অধিক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে সেগুলো থেকে কয়েকটি নির্বাচিত করে অর্থ বুঝে বার বার পড়া যেতে পারে। ইস্তেগফার ও দরুদ আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। কমপক্ষে ১০০ বার ইস্তেগফার এবং ১০০ বার দরুদ পড়া যেতে পারে। হযরত আয়েশা রা: বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাঃ কে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ- যদি কোনো প্রকারে আমি জানতে পারি রাতটি লাইলাতুল কদর তাহলে কি দোয়া করবো?
জবাবে নবী সাঃ বলেন, এ দোয়া পড়বে- আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুব্বুন কারিমুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।” অর্থাৎ ‘আয় আল্লাহ তুমি বড়ই মাফ করণে ওয়ালা এবং বড়ই অনুগ্রহশীল। মাফ করে দেয়াই তুমি পছন্দ কর। অতএব তুমি আমাদেরা গুনাহগুলো ক্ষমা করে দাও।’
[আরো পড়ুনঃ] কিভাবে উদ্যোক্তা হওয়া যায়
লায়লাতুল কদরের জন্য দোয়া/প্রার্থনা
যেহেতু লায়লাতুল কদর একটি বিশেষ রাত, তাই প্রতিদিনের রমজানের দোয়া ছাড়াও একজন মুসলমানের জন্য বিশেষ দুআ করা অপরিহার্য। লায়লাতুল কদরের সময় একজন মুসলমান এর যে বিশেষ দুআ গুলো করতে হয় সে সম্পর্কে, আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, তিনি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন:
“হে আল্লাহর রাসূল! (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), যদি আমি জানতাম এই রাতটি লাইলাতুল কদর, তাহলে আমি কি দোয়া করবো? মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে নিম্নের দোয়াটি পাঠ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন: "আল্লাহুম্মা ইন্নাকা 'আফুউউউন তুহ ইববুল 'আফওয়া ফা'ফু'আন্নি"।অনুবাদঃ হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, এবং আপনি ক্ষমা ভালবাসেন. তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন। (তিরমিযী)।
শবে কদরের নামাজের নিয়ত
‘নাওয়াইতু আন্ উছাল্লিয়া লিল্লাহি তা’য়ালা রাকআতাই সালাতিল লাইলাতিল কাদ্রি নফ্লে মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি- আল্লাহু আকবর।’ অর্থঃ আমি কাবামুখী হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শবে কদরের দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ার নিয়ত করলাম- আল্লাহু আকবর।
[আরো পড়ুনঃ] রমজান সম্পর্কে হাদিস
শবে কদরের নামাজের নিয়ম
শবে কদরের নামাজ দুই রাকাত করে ৪ রাকাত পড়তে হয়। এরপর যত ইচ্ছা নফল নামাজ পড়া যায়। এই নামাজের প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর একবার সূরা কদর এবং তিনবার সূরা ইখ্লাস পড়তে হয়। নামাজ শেষে নিচের দোয়াটি কমপক্ষে ১০০ বার পড়া উত্তমঃ ‘সুব্হানাল্লাহি ওয়াল হাম্দু লিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর, লা হা’ওলা কুয়্যাতা ইল্লাবিল্লাহিল্ আলীয়্যিল আযীম।’
শেষ কথাঃ
উপসংহারে বলা যায় প্রত্যেক মুসলমান এর জন্য এটা অপরিহার্য যে তারা রমজানের শেষ দশদিনে লাইলাতুল কদর খুঁজে বের করবে। উপরোক্ত আমলের মাধ্যমে আমরা এ পবিত্র রাতটি কাটাতে পারি। রমজানের শেষ দশ দিনের সমস্ত বেজোড় রাতের পাশাপাশি জোড় রাতগুলোতেও বেশি বেশি ইবাদত করা উচিত। কেননা পুরো রমজান মাসই হলো দোয়া কবুলের মাস।
যারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা আশা করে তাদের উচিত এই রমজান মাসকে কাজে লাগানো। প্রতিটই রাতকেই বিশেষ ভাবে নিয়ে ইবাদত করা। এটি করলে লায়লাতুল করদ এর রাত এমনিই তেই পাওয়া যাবে। পাশাপাশি অতিরিক্ত ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমা এবং অনুগ্রহও পাওয়া যাবে। আল্লাহ আমাদের সঠিক ভাবে ইবাদত করার তৌফিক দিন আমিন।
আর্টিকেল সম্পর্কিত তথ্য জানতে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।