কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার — মানব দেহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হলো কিডনি। পৃথিবীতে মানবজাতি যেসকল প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃ- ত্যু বরণ করছে তন্মধ্যে কিডনি রোগ হচ্ছে অন্যতম। এই কিডনি রোগ খুবই নীরবে শরীরের ক্ষতিসাধন করে থাকে। কিডনি রোগ অনেক বেশি জটিল অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সাধারণত লক্ষণগুলো ভালোভাবে প্রকাশও পায়না। তাই আমাদের সকলের কিডনি রোগের লক্ষণ গুলো সম্পর্কে পূর্বে থেকেই জেনে রাখা জরুরি। সেই সাথে সকলের জানা প্রয়োজন কিডনি রোগের প্রতিকার এবং সঠিক চিকিৎসা সম্পর্কে।
আজকের এই আর্টিকেলের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ‘কিডনী রোগের লক্ষণ সম্পর্কে জানা এবং কিডনী রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার গুলো কি কি তা সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা। এখানে আলোচনা করা কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার গুলো বিভিন্ন ডাক্তারগণের সঠিক পরামর্শে অনুযায়ী লেখা হয়েছে।
আরো পড়ুনঃ গ্যাস্ট্রিক দূর করার উপায়
প্রশ্নঃ অনেকেই রয়েছেন যারা কোমড় ব্যথা হলে কিংবা প্রস্রাব হলুদ হলে ভয়ে মনে করেন যে তার কিডনিতে সমস্যা হয়ছে। আসলে কিডনি রোগ হলে তার লক্ষণগুলো কি কি হবে?
উত্তরঃ আসলে কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার লক্ষণ যদি বলা হয় তাহলে ৭০% থেকে ৮০% কিডনি বিকল হওয়ার পূর্বে কোনভাবেই প্রকাশ পায়না। এই অবস্থায় দেখা যায় যে, খাওয়া দাওয়াতে অরুচী ভাব দেখা দেয়, মাঝে মধ্যে ঘুম থেকে উঠার পরে চোখ-মুখ ফোলা ফোলা ভাব দেখানো অর্থাৎ চোখের নিচের অংশে বেশি ভারি ভারি হয়ে থাকে এবং বমি বমি ভাব হয়। এছাড়াও ধীরে ধীরে শরীরে রক্তশূণ্যতা দেখা দেয়। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
আর যদি কিডনি রোগ বেশি ঝুঁকিতে থাকে তাহলে বিনা কারণে শরীর চুলকাতে থাকবে, গায়ের রং চেঞ্জ হয়ে যাবে। রাতে বেশি বেশি প্রস্রাব করতে হয়। অনেকের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। মোটকথা দেহ তো একটাই। যখন এটি অনেক বেশি আক্রান্ত হয় তখন সকল অঙ্গগুলো ধীরে ধীরে জড়িত হয়ে পড়ে। সেজন্য এই কিডনি রোগটিকে নিরব ঘাতক অর্থাৎ সাইলেন্ট কিলার বলা হয়ে থাকে।
আরো পড়ুনঃ কি খেলে গায়ের রং ফর্সা হয়
প্রশ্নঃ কিডনি বিকল কি এমনি এমনি হয়?
উত্তরঃ এই প্রশ্নের জবাব হবে না। কখনই শুধু শুধু অর্থাৎ কোনো কারণ ব্যতীত কিডনি বিকল হয়ে য বেনা। শরীরে অনেকগুলো রোগের শেষ পরিনতি হচ্ছে কিডনি রোগ। কিডনি রোগ হওয়ার পূর্বে উক্ত রোগগুলোকে প্রাথমিক অবস্থাতে শনাক্ত করা সম্ভব। যেমনঃ শরীরে যদি প্রস্রাব কমে যায়। কিংবা অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় আগে রাতে অনেক বেশি প্রস্রাব হতো না কিন্ত এখন রাতে অনেক প্রসাব হচ্ছে।
প্রস্রাব করার ক্ষেত্রে জালাপোড়া করে। প্রস্রাব করার পরেও কিছু প্রস্রাব থেকে যায়। এর সাথে কোমড়ের ২ পাশে ব্যথা ও কাপুনি থাকে। আবার দেখা যাচ্ছে প্রস্রাবে অনেক বেশি ফেনা সৃষ্টি হয় এবং মুখ ফুলে যায়। যদি উক্ত সমস্যা গুলো দেহে দেখা যায় তবে এগুলোকে কিডনির প্রদাহ বোঝায়।
আবার অনেক সময় দেখা যায় যে, প্রস্রাবের রং লাল হচ্ছে অর্থাৎ প্রস্রাবের সাথে রক্ত বাহির হচ্ছে। তবে হ্যাঁ প্রসাবের সাথে এই রক্ত বাহির অনেকগুলো কারণেও কিন্ত হতে পারে। যেমনঃ যদি কিডনিতে পাথর থাকে। কিডনিতে টিউমার থাকলে এই রকম সমস্যা হতে পারে।
এছাড়াও অনেক কারণে প্রস্রাবের সাথে রক্ত বাহির হতে পারে। অনেক সময় কিন্ত ভিটামিন খাওয়ার ফলে প্রস্রাব হলুদ হয়ে যায়। আবার পানি কম খাওয়ার কারণে প্রসাব হলুদ হতে পারে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠলেও প্রস্রাবের রং হলুদ হতে পারে। এটা মূলত কোনো রোগ নয়।
আরো পড়ুনঃ লম্বা হওয়ার উপায় ও ব্যায়াম
প্রশ্নঃ এমন কোনো লক্ষণ বা কারণ কি নেই যা দেখে রোগী বুঝতে পারবে যে তার কিডনি খারাপের দিকে যাচ্ছে?
উত্তরঃ যদি আপনি এমন প্রশ্ন করে থাকেন তবে সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। উপরে অনেক গুলি লক্ষণ বলেছি প্রস্রাব সম্পর্কে। এছাড়াও অনেক সময় কোমড় ব্যথার মতো সমস্যা হতে পারে। তলপেটে ব্যথা হতে পারে। তবে হ্যাঁ মনে রাখা ভালে কোমড়ে যে ব্যথা হয় তার ৯০% হয় স্পাইন থেকে। পেটের পেছনের দিকে কিছু অঙ্গ রয়েছে সেগুলোতে যদি টিউমার কিংবা ক্ষত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেও ব্যথা হতে পারে। তবে হ্যাঁ সাধারণত ১০% কারণে কিডনির জন্যে হয়ে থাকে। যদি কিডনিতে পাথর হয়ে থাকে, টিউমার হয়ে থাকে, প্রস্রাব প্রবাহে কোনো প্রকার বাঁধা সৃষ্টি হয় তাহলে এই সমস্ত কারণেও হতে পারে।
প্রশ্নঃ প্রধান কি কি লক্ষণ দেখা দিলে রোগী বুঝতে পারবে যে তার কিডনিতে সমস্যা হয়েছে?
উত্তরঃ এক্ষেত্রে কিছু বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যদি শরীর ফুলে যায়, আর যদি সেই ফোলাটা শুরু হয় মুখমন্ডল থেকে। প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কমে গেলে। যদি প্রস্রাব লাল হয় কিংবা প্রসাবে রক্ত বাহির। যদি কোমড়ের ২ পাশে ব্যথা অনুভব হয় বা ব্যথা হয়। এই ব্যথা কিন্ত তলপেট থেকেও হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিলে। এগুলা ছাড়াও আরো কিছু রোগ রয়েছে যেগুলো শরীরে বিদ্যামান থাকলে তাদেরকে অবশ্যই কিডনি পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
যেমনঃ যদি কারো ডায়াবেটিক থাকে, কখন যদি কারো মুখমন্ডল ফুলে যায়, উচ্চ রক্তচাপ থাকে, যদি কারো ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বৃদ্ধি পায় বা বেশি থাকে, এমন কোনো মানুষ যদি থাকেন যে অনেক বেশি হাটাচলা করেন না, শুধু বসে বসে কাজ করেন, কোনো করণে যার দীর্ঘদিন ব্যথার ঔষুধ খাওয়ার প্রয়োজন হয়েছে এবং যারা পানি কম পরিমাণে খেতে অভ্যস্থ, যদি বংশে কারো কিডনি রোগ থাকে। সেসকল ইতিহাস থাকলে বছরে অন্তত ২ বার কিডনি পরীক্ষা করা দরকার।
আরো পড়ুনঃ কেক বানানোর রেসিপি
কিডনি রোগের প্রতিকার
রোগ প্রতিকার করা কঠিন ব্যাপার হলেও প্রাথমিক অবস্থাতে কিডনি রোগ ধরা পড়লে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব। সেজন্য ডাক্তারের কথা অনুযায়ী চলতে হবে। তবে কিডনি রোগের প্রতিকার করা যাবে। প্রতিদিন অন্তত ৮ গ্লাস বা ২ লিটার বা ৩ লিটার বিশুদ্ধ পানি পান করা। আর হ্যাঁ ব্যায়াম কিংবা শারীরিক পরিশ্রমের ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণে পানি পান করা দরকার। তবে যাদের শরীরে ফোলা ভাব রয়েছে তারা পরিমাণ মতো পানি পান করবেন।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং শরীরচর্চা করা। ডায়বেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের রাখা। যাদের বয়স ৪০ এর অধিক তাদের খাবারে লবণের মাত্রা কমিয়ে আনা। ধূমপান, তামাক, মদ কিংবা নেশা জাতীয় যাবতীয় খাবার বর্জন করা। খাবারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত কোনো ওষুধ সেবন না করা। এগুলো হচ্ছে কিডনি ভালো রাখার অন্যতম সেরা উপায়। কিডনিতে ইনফেকশন হলে প্রাথমিকভাবে এগুলো হচ্ছে করনীয়।
আরো পড়ুনঃ শীতে ফর্সা হওয়ার উপায়
দানা কিংবা বীজ জাতীয় খাবার বেশি বেশি খান যেমনঃ ব্রেড, বাদাম, নুডুলস ইত্যাদি। সপ্তাহে অন্তত ১টি করে কচি ডাবের পানি খাওয়ার চেষ্টা করুন। প্রতিদিন অন্তত ৪টি থানকুচি পাতা খেতে হবে। শশা, তরমুজ, বাঙ্গি, লাউ, কমলালেবু, মাল্টা, লেবু, ডালিম, বীট, গাজর, আখের রস, পিয়াজ, বার্লি, সাজনা ইত্যাদি পরিমাণ মতো খেতে হবে। এছাড়াও কিডনি রোগের প্রতিকার করার জন্য পাথরকুচি পাতা খেতে পারেন। গবেষণায় জানা গেছে পাথরকুচি পাতার নির্যাস কিডনি পাথর ধ্বংস করতে অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে।
কিডনি রোগ দেখা দিলে প্রসাব এর পরিমাণ কমে যায়। আর সেই সমস্যার জন্য রক্ত চন্দন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। রক্ত চন্দন কিডনি রোগীদের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ। রক্ত চন্দন ডাই-ডাইরুটিক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া রক্ত চন্দন প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া বন্ধ করা এবং প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
কিডনি রোগী যা যা খেতে পারবে না
১.সবজিঃ বাধাকপি, ফুলকপি, গাজর, শিম, ঢেঁড়স, বরবটি, শিমের বীচি, কাঁঠালের বীচি, মিষ্টি কুমড়ার বীচি, মুলা, কচু। পুঁই শাক, পালং শাক, মুলা শাক। চকোলেট, চকোলেট দুধ, পনির, মুরগীর মাংস, গরুর মাংস, খাসির মাংস, সস, ব্রকোলি, পিচস, বাদাম, মাশরুম, টমেটো, কলা, খেজুর ও আচার। এছাড়াও ডাব, শুটকি, শুকনো ও টকজাতীয় ফলসহ কোনো প্রকার আচার/চাটনী খাওয়া যাবেনা। তবে হ্যাঁ ডাক্তারের দেয়া খাদ্য তালিকা অনুসরণ করা অবশ্যই বাধ্যতামূলক।
আর্টিকেল সম্পর্কিত তথ্য জানতে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।