জানাজার নামাজের নিয়ম - জানাজার নামাজ পড়ার নিয়ম — 'প্রতিটি প্রাণকে একদিন মৃ- ত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে।’ (সূরাঃ আল ইমরান, আয়াত ১৮৫) কোনো মানুষই চিরজীবী নয়। প্রতিটি মানুষকে একদিন পরপারে যেতেই হবে। যে শিশু আজ জন্মগ্রহণ করলো তাকেও একদিন না একদিন এই সুন্দর সাজানো গোছানো পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হবে, যেতেই হবে পরপারে। এই নির্দিষ্ট সময়ের সুন্দর সাজানো গোছানো পৃথিবীটি মানুষের জন্য একটি পরীক্ষা মাত্র।
কোনো মৃ- ত মুসলমানকে কবর দেয়ার আগে অনুষ্ঠিত বিশেষ প্রার্থনাকে জানাজা বলা হয়। সাধারণত আমরা এটিকে জানাজার নামাজ নামে বলে থাকি। মুসলমান অর্থাৎ ইসলাম ধর্মামলম্বীদের জন্যে জানাজার নামাজ ফরযে কেফায়া কিংবা সমাজের জন্য আবশ্যকীয় দায়িত্ব।
অর্থাৎ কোনো মুসলমান ব্যক্তি মৃ- ত্যু বরণ করলেই মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে অবশ্যই জানাজার নামাজ আদায় করতে হবে। তবে হ্যাঁ কোনো এলাকা কিংবা গোত্রের পক্ষ থেকে ১ জন মাত্র আদায় করে নিলে ঐ এলাকার সকলের পক্ষ থেকে জানাজার নামাজ আদায় হয়ে যাবে।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে মুসলিম মৃ- ত ব্যক্তির জানাজার নামাজে আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করে নাই এমন ৪০ জন লোক নামাজ আদায় করবে, তবে মৃ- ত ব্যক্তির ব্যাপারে তাদের সুপারিশ আল্লাহ তায়ালা কবুল করবেন।’ (মুসলিম)
জানাজার জন্যে লাশ কিবলার দিকে রাখতে হবে। লাশ যদি পুরুষ হয়ে থাকে তাহলে, মাথার পাশ বরাবর ইমাম সাহেব দাঁড়াবেন। আর লাশ যদি মহিলা হলে তাহলে মধ্যবর্তী স্থানে ইমাম সাহেব দাঁড়াবেন, এটাই হচ্ছে আমাদের প্রিয় নবী মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের সুন্নত।
আরো পড়ুনঃ সালাতুল হাজত নামাজের নিয়ম
পেজ সূচীপত্রঃ জানাজার নামাজের নিয়ম
জানাজার নামাজ
জানাজার নামাজ একজন ইমামের নেতৃত্বে জামায়াতের সঙ্গে অর্থাৎ দলবদ্ধভাবে এই নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এই নামাজে অংশগ্রহণকারীরা বেজোড় সংখ্যক কাতারে কিংবা সারিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে এই নামাজ আদায় করেন। জানার নামাজ হচ্ছে ৪ তকবিরের নামাজ। জানাজার নামাজ দাঁড়িয়ে আদায় করতে হয় এবং সালাম ফেরানোর মধ্য দিয়ে এই নামাজ শেষ হয়।
সাধারণত জানাজার নামাযের শেষে মুনাজাত কিংবা সম্মিলিত দোয়া পাঠ করতে হয়না। কেননা ইসলামের প্রতিষ্ঠিত বিধান অনুযায়ী জানাজার নামাজের মাধ্যমেই মৃ- তের জন্য দোয়া করা হয়ে থাকে। জানাজা শেষে মৃ- ত ব্যক্তিকে অবিলম্বে কবরস্থানে নিয়ে যেতে হয় এবং ইসলামী নিয়ম কানুন অনুযায়ী কবর তৈরি করে মাটিতে দাফন সম্পন্ন করতে হয়।
জানাজার নামাজের নিয়ম
(১) কাতারবদ্ধ হয়ে ইমামের পিছনে দাঁড়ানোর পর নিয়ত করে প্রথম তাকবিরের পর ছানা পাঠ (২) দ্বিতীয় তাকবীরের পর দরুদে ইবরাহীম পাঠ (৩) তৃতীয় তাকবিরের মৃ- ত ব্যাক্তির জন্য দোয়া পড়বেঃ ‘‘আল্লাহুম্মাগ ফিরলী হাইয়েনা ওয়া মাইয়্যাতিনা” শেষ পর্যন্ত এবং “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতে” শেষ পর্যাপ্ত পাঠ (৪) চতুর্থ তাকবির দিয়ে সালাম ফিরিয়ে, হাত নামিয়ে জানাজার নামাজ শেষ করতে হয়।
৪ তাকবীরের সঙ্গে জানাজার নামাজ আদায় করতে হয়। ঈদের নামাজ পড়ার সময় তাকবীর দেওয়ার সময় হাত তুলতে হয়, কিন্ত জানাজার নামাজে তাকবীর দেওয়ার সময় হাত তোলার প্রয়োজন হয়না।
আরো পড়ুনঃ তাহাজ্জুদ নামাজের সময়
জানাযার নামাজ কত রাকাত?
জানাজার নামাজ হল ১ রাকাত। জানাজার নামাজে একই রাকাতে চারটি তাকবীর (জোরে আল্লাহু আকবার বলা) আছে। জানাজার নামাজের ইমামতিকারী ইমাম উচ্চস্বরে প্রথম তাকবীর (অর্থাৎ আল্লাহু আকবার) বলবে। এখানে ইমামকে অনুসরণ করতে হবে এবং হাত কান বা কাঁধ পর্যন্ত তুলতে হবে এবং তারপরে ভাঁজ করতে হবে।
জানাজার নামাজের নিয়ত
نَوَيْتُ اَنْ اُؤَدِّىَ لِلَّهِ تَعَا لَى اَرْبَعَ تَكْبِيْرَاتِ صَلَوةِ الْجَنَا زَةِ فَرْضَ الْكِفَايَةِ وَالثَّنَا ءُ لِلَّهِ تَعَا لَى وَالصَّلَوةُ عَلَى النَّبِىِّ وَالدُّعَا ءُلِهَذَا الْمَيِّتِ اِقْتِدَتُ بِهَذَا الاِْمَامِ مُتَوَجِّهًا اِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِ يْفَةِ اَللَّهُ اَكْبَرُ
বাংলা উচ্চারণঃ "নাওয়াইতু আন উয়াদ্দিয়া লিল্লাহে তায়ালা আরবা আ তাকবীরাতে ছালাতিল জানাজাতে ফারজুল কেফায়াতে আচ্ছানাউ লিল্লাহি তায়ালা ওয়াচ্ছালাতু আলান্নাবীয়্যে ওয়াদ্দোয়াউ লেহাযাল মাইয়্যেতে এক্কতেদায়িতু বিহাযাল ইমাম মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতে আললাহু আকবার।"
জেনে রাখা ভালো এখানে নিয়তে ‘লেহাযাল মাইয়্যেতে’ পুরুষ/ছেলে লাশ হলে পড়তে হবে, আর লাশ নারী/মেয়ে হলে ‘লেহাযিহিল মাইয়্যেতে’ বলতে হবে।
জানাজার নামাজের নিয়ত আরবিতে করতে না পারলে বাংলায় করলেও হবে। জানাজার নামাজের নিয়ত বাংলায়ঃ ‘আমি ৪ তাকবিরের সহিত ফরজে কিফায়া জানাজার নামাজ কিবলামুখী হয়ে ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে মরহুম ব্যক্তির (পুরুষ/মহিলার) জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্যে আদায় করছি। আল্লাহু আকবার।’
জানাজার নামাজে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও রাসূলের উপর দরুদ পাঠ করা হয়। বাংলায় নিয়ত করলে তা বাংলায় বলে অথবা মনে মনে নিয়তে আনলেও চলবে। নিয়তে তাকবীরে তাহরিমা অর্থাৎ, আল্লাহু আকবার বলার পর হাত তুলে তারপর অন্যান্য নামাজের মতো হাত বেঁধে নিতে হবে। হাত বেধে সানা পড়তে হবে। আরবিতে সানা: سُبْحَا نَكَ اَللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَا لَى جَدُّكَ وَجَلَّ ثَنَاءُكَ وَلاَ اِلَهَ غَيْرُكَ
সানা বাংলা উচ্চারণঃ সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারা কাসমুকা ওয়া তায়ালা জাদ্দুকা, ওয়া জাল্লা ছানাউকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।
সানা পড়ার পরে তাকবীর বলে দরুদ শরীফ পড়তে হবে যেটা সাধারণ নামাজে তাশাহুদের পর পড়া হয়। দরুদ শরীফঃ للَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى اَلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى اِبْرَا هِيْمَ وَعَلَى اَلِ اِبْرَ اهِيْمَ اِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ- اَللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى اَلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى اِبْرَا هِيْمَ وَعَلَى اَلِ اِبْرَا هِيْمَ اِنَّكَ حَمِيْدٌمَّجِيْدٌ
দরুদ শরীফ বাংলা উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মাদি ওয়া আলা আলি মুম্মাদিন কামা সাল্লাইতা আলা ইব্রাহিমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহিমা ইন্নাকা হামিদুম্মাজীদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইব্রাহিমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহিমা ইন্নাকা হামীদুম্মাজীদ। দরুদ শরীফ পড়ার পর তৃতীয় তাকবীর আদায় করে জানাযার দোয়া পড়তে হয়।
আরো পড়ুনঃ যৌবন ধরে রাখার উপায়
জানাজার নামাজের দোয়া
জানাজার নামাজের দোয়া আরবিতেঃ لَّهُمَّ اغْفِرْلحَيِّنَاوَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيْرِنَا وَكَبِيْرِنَا وَذَكَرِنَا وَاُنْثَا نَا اَللَّهُمَّ مَنْ اَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَاَحْيِهِ عَلَى الاِسْلاَمِ وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الاْيمَانِ بِرَحْمَتِكَ يَا ارْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ
জানাজার নামাজের দোয়া বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাগফিরলি হাইয়্যেনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িইবিনা ও ছাগীরিনা ও কাবীরিনা ও যাকারিনা ও উনছানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আলাল ইসলামী ওয়া মান তাওয়াফ ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফ ফাহু আলাল ঈমান বেরাহমাতিকা ইয়া আর হামার রাহীমিন।
তবে নাবালক ছেলের ক্ষেত্রে জানাযার দোয়া পড়তে হবেঃ اَللَّهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا فَرْطًا وْاَجْعَلْهُ لَنَا اَجْرًا وَذُخْرًا وَاجْعَلْهُ لَنَا شَافِعًا وَمُشَفَّعًا
বাংলা উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মাজ আল হুলানা ফারতাও ওয়াজ আল হুলানা আজরাও ওয়া যুখরাঁও ওয়াজ আলহুলানা শাফিয়াও ওয়া মুশাফ্ফায়ান।
নাবালিকা মেয়ের ক্ষেত্রে জানাযার দোয়া পড়তে হবেঃ اللَّهُمَّ اجْعَلْهَا لَنَا فَرْطًا وَاجْعَلْهَا لَنَا اَجْرًا وَذُخْرًاوَاجْعَلْهَا لَنَا شَافِعَةً وَمُشَفَّعَة
বাংলা উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মাজ আলহা লানা ফারতাও ওয়াজ আলহা লানা আজরাও ওয়া যুখরাও ওয়াজ আলহা লানা শাফিয়াও ওয়া মুশাফ ফায়ান।
এরপর চতুর্থ তাকবীর দিয়ে একটু নীরব থেকে ডানে এবং বামে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করতে হবে। যদি কারো নামাজে আসতে দেরী হয়ে যায়, তবে ইমাম সাহেবকে অনুসরণ করতে হবে। সম্ভব হলে ৪ তাকবীর আদায় করে নিতে হবে, তা যদি সম্ভব না হয়, তবে ইমাম সাহবকে অনুসরণ করে সালাম ফিরিয়ে নিয়ে জানাজা নামাজ সম্পন্ন করবে। জানাজা নামাজ জামাতে আদায় করতে হয়, তাই এটি কাজা পড়ার সুযোগ নেই।
আরাে পড়ুনঃ দুই অক্ষরের মেয়েদের ইসলামিক নাম অর্থসহ
জানাজার নামাজের ফজিলত
জানাজার নামাজ ফরযে কেফায়া হওয়ার কারণে জানাজার নামাজ সমাজের কিছু মানুষ আদায় করলে দায়মুক্ত হওয়া যাবে। তবে, কেউ আদায় না করলে একসঙ্গে সকলেই পাপের ভাগীদার হবে। সমস্যা থাকলে বা গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলে একি এলাকার অন্য কেউ নামাজ পড়লে গুনাহগার হবেনা।
ঈমানের সঙ্গে ছাওয়াবের নিয়তে মৃ- ত ব্যাক্তির জানাজা পড়া এবং দাফন সম্পন্ন পর্যন্ত গোরস্থানে অপেক্ষা করা সুন্নাত। মৃ- ত ব্যক্তির দাফনের জন্যে কবরস্থানে যাওয়া পুরুষদের জন্য বৈধ। মহিলাদের জন্য তা বৈধ নয়। জানাজার পর দাফন পর্যন্ত অপেক্ষার ব্যাপারে আমাদের প্রিয় নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদিস আছে। যা তুলে ধরা হলোঃ
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত নিশ্চয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো মৃ- ত মুসলিম ব্যক্তির জানাজায় ঈমান সহকারে এবং ছাওয়াবের আশায় শরিক হয় এবং জানাজা ও সমাধি পর্যন্ত থাকে সে ২ কিরাত নেকি পাবে। প্রতি কিরাত মানে হচ্ছে ওহুদ পাহাড়ের সমান। আর জানাজা পড়ে দাফনের পূর্বে ফিরে যাবে সে ১ কিরাত নেকি নিয়ে ফিরবে। (বুখারি, মুসলিম)
সুতরাং সময় এবং সুযোগ থাকলে জানাজার নামাজের পর মৃ- ত ব্যক্তিকে দাফন পর্যন্ত কবরস্থানে অপেক্ষা করে ২ কিরাত নেকি লাভ করা উত্তম কাজ। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে ২ কিরাত নেকি লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
জানাজার নামাজের নিয়ম, জানাজার নামাজ পড়ার নিয়ম, জানাজার নামাজ পড়ার নিয়ম ও দোয়া, জানাজার নামাজ পড়ার সঠিক নিয়ম, জানাজার নামাজ কত রাকাত, জানাজার নামাজ পড়া কি, জানাজার নামাজ কয় তাকবীর, জানাজার নামাজ পড়ানোর নিয়ম, জানাজার নামাজ কতবার পড়া যায়, জানাজার নামাজের দোয়া আরবিতে, জানাজার নামাজের ইমামতির নিয়ম লেখাটি সম্পর্কে আপানাদের কোনো বিষয় সম্পর্কে আপনার জানানোর প্রয়োজন হলে অবশ্যই অবশ্যই কমেন্টে জানিয়ে দিবেন। আর লেখাটি শেয়ার করে অন্যদেরকে দেখার সুযোগ করে দিন।
আর্টিকেল সম্পর্কিত তথ্য জানতে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।