দেনমোহর পরিশোধ না করার শাস্তি কি

হাসিবুর
লিখেছেন -
0

দেনমোহর পরিশোধ না করার শাস্তি কি - দেনমোহর বা মোহরানা অথবা কাবিন যে নামেই ডাকি না কেন আমাদের বিয়ের সময় ইসলামী পরিভাষায় বৈধভাবে যে আর্থিক লেনদেন করা হয়, মূলত থাকেই আমরা মোহরানা বা দেনমোহর বলে থাকি। অথবা বলা যায়, স্ত্রীর প্রতি সম্মানের প্রতীক হিসেবে, টাকা বা অন্য কোনো সম্পত্তি যা বিয়ের প্রতিদান স্বরূপ স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রী পাওয়ার অধিকার রাখে, তাই দেনমোহর। এই দেনমোহর সম্পর্কে বা দেনমোহর পরিশোধ না করার শাস্তি কি হতে পারে তা আজকে আমরা জেনে নিবো।

কাবিনের সময় অথবা বিয়ের আসরেই দেনমোহর পরিশোধ করা উচিত। কিন্তু অতি উচ্চ মাত্রায় দেনমোহর দাবি করা উচিত নয়, স্বামীর সামর্থের ভিতরে, যা সে বিবাহের পরে বা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগেই পরিশোধ করে দিতে পারে সে অনুযায়ী দেনমোহর ধার্য করা উচিত। বিয়েতে বর ও কনের উভয়ের স্বার্থ ও মর্যাদা বজায় রাখা উচিত। তো আসুন এবার আমরা জেনে নেই, দেনমোহর পরিশোধ না করার শাস্তি কি?

(toc) #title=(সুচিপত্র)

দেনমোহর পরিশোধ না করার শাস্তি কি

দেনমোহর পরিশোধ না করার শাস্তি কি

দেনমোহর পরিশোধ না করার শাস্তি কি তা হচ্ছে, স্বামী যদি স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ না করে অথবা স্ত্রী যদি উক্ত দেনমোহর মাফ না করে, তবে অবশ্যই কিয়ামতের ময়দানে সেই স্বামী অপরাধী সাব্যস্ত হবে। কুরআনে বলা হয়েছে, তোমরা খুশি মনে তোমাদের স্ত্রীদের তাদের দেনমোহর পরিশোধ করে দাও। স্ত্রীরা যদি খুশি হয়ে কিছু অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দে ভোগ করতে পারবে (সূরা নিসা,আয়াত নং ৪)। তাই দেনমোহরের টাকাটা পরিশোধ করে দেওয়াটাই উত্তম।

স্বামী দেনমোহর পরিশোধ না করলে তা ঋণ হিসেবে বাকি থেকে যাবে। স্ত্রী যদি দেনমোহর ছাড়াই সহ বাসের অনুমতি প্রদান করেন তবে এতে কোন সমস্যা নেই। দেনমোহর প্রদান না করলে স্ত্রী সহ বাসের পূর্বে বাধা প্রদান করতে পারবেন এবং কিন্তু একবার সহ বাস হয়ে গেলে আর বাধা প্রদান করতে পারবেন না। কিন্তু সহ বাসের আগেই দেনমোহর পরিশোধ করা উচিত।

রাসূল (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন নারীকে দেনমোহর দেওয়ার ওয়াদা করে বিয়ে করেছে, কিন্তু পরে দেনমোহর দিতে অস্বীকার করে, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট ব্যভিচারী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে এবং দেনমোহর আদায় না করলে দুনিয়া ও আখিরাতে স্ত্রীর নিকট ঋণগ্রস্ত থাকতে হবে। সুতরাং প্রতারণা ছাড়াই, স্ত্রীকে হালাল ভাবে উপভোগ করতে দেনমোহর পরিশোধ করে দেওয়া উত্তম। দেনমোহর পরিশোধ না করার শাস্তি কি তা আমরা জেনে নিলাম।

আরো পড়ুনঃ মোহরানা ও কাবিন এর মধ্যে পার্থক্য

কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম

ইসলামের দৃষ্টিতে, স্বামীর সামর্থ্য অনুযায়ী মোহরানা ধার্য করা উচিত এবং দেনমোহর নগদেই পরিশোধ করা উত্তম। কিন্তু যদি বেশি মোহর নির্ধারণ করে ফেলেন, একসাথে পরিশোধ করতে না পারেন, তবে অবশ্যই অল্প অল্প করে কিস্তিতে তা আদায় করে দিতে পারবেন। 

স্বামী, স্ত্রীর মধ্যে যদি কোনো কারনে ডিভোর্স হয় এবং স্বামীর একসাথে দেনমোহর পরিশোধ করার সামর্থ্য না থাকে তাহলে আইননুসারে, আপনাকে একটা নির্দিষ্ট পরিমানে সময় প্রদান করা হবে, যাতে নির্দিষ্ট সময় পরপর কিস্তি আকারে আপনি আপনার দেনমোহর পরিশোধ করতে পারবেন।

লোক দেখানো উদ্দেশ্যে বেশি পরিমাণে মোহরানা ধার্য করা এবং পরে স্ত্রীর কাছে মাফ চাওয়া, তা খুব বড় ধোকার শামিল। আমাদের সমাজে কিছু কুপ্রথা রয়েছে, যা স্বামী মৃ-ত্যুর সময় স্ত্রীর নিকট থেকে মোহরানা বা দেনমোহর মাফ করিয়ে নেওয়া, তা প্রতারণাপূর্ণ ও চরম অন্যায় কাজ। মুমিনরা এমন কাজ থেকে অবশ্যই বিরত থাকবেন। স্বামীর উচিত দেনমোহর প্রদান করার সুযোগ পেলেই তা পরিশোধ করে দেওয়া।

আরো পড়ুনঃ দ্রুত বিয়ে ও উত্তম জীবনসঙ্গী পাওয়ার আমল

তালাকের পর দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম

দেনমোহর স্ত্রীর হক, অবশ্যই স্ত্রীর হক পরিপূর্ণভাবে পরিশোধ করে দিতে হবে, তালাক যে পক্ষ থেকেই হোক না কেন। আমাদের সমাজের মানুষের মধ্যে একটা নিয়ম চালু আছে, যেকোনো নারী উনার পক্ষ থেকে তালাক প্রদান করলে, স্বামীর দেনমোহর পরিশোধ করতে হয় না। নিতান্তই একটি ভুল ধারণা, তালাক যে কারো পক্ষ থেকেই হোক স্বামী অথবা স্ত্রী, স্বামীকে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে।

তালাকের মুহূর্তে যদি আপনার দেনমোহর পরিশোধ করার সামর্থ্য না থাকে, তবে আইনানুসারে নির্দিষ্ট তারিখে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। এবং ইসলামের শরীয়ত অনুযায়ী, বিয়ের পূর্বে অথবা বিয়ের সময়ই দেনমোহর পরিশোধ করে দেওয়া উচিত। তা না পারলে বিয়ের পরে আস্তে আস্তে পরিশোধ করে ফেলা। অথবা তালাকের পরে দুই পরিবারের লোক একত্রিত হয়ে একটা নির্দিষ্ট সম্মতিতে আসা, বরপক্ষ একবারে পারলে একসাথে দেনমোহর পরিশোধ করবেন বা কনেপক্ষের সম্মতিতে ২-৩ বারেও পরিশোধ করতে পারেন।

দেনমোহর আদায়ের মামলা

স্ত্রীর হক বা স্বামী দেনমোহর দিতে অস্বীকার করলে, স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে দেনমোহর আদায়ের জন্য আদালতে মামলা করতে পারেন। দেনমোহর সংক্রান্ত মামলা পারিবারিক আদালত নামে পরিচিত সেখানে করতে পারবেন অথবা স্থানীয় সরকারী জজ আদালতেও মামলা করতে পারবেন।

আইন অনুযায়ী, ১৯০৮ সালের তামাদী আইন, (তফসিল -১ ও অনুচ্ছেদ - ১০৪) বিলম্বিত। এটা দেনমোহর আদায়ের সময়সীমা, স্বামীর মৃ-ত্যু অথবা তালাকের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে এই তারিখটি হতে ৩ বছর।

বিলম্বিত ওই তারিখ হতে দেনমোহরের দাবীতে স্বামীর সম্পত্তিতে বিধবা নারীর বৈধ দখলে থাকাকালীন তামাদীর মেয়াদ বিধবা নারীর বিপক্ষে যাবে না। অথবা স্ত্রী লিখিতভাবে তালাক প্রাপ্ত হলে তামাদীর আইনের ১০৩ ও ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্ত্রীকে উক্ত লিখিত তালাক দানের সংবাদটি শোনার তারিখ হতে তামাদীর সময় শুরু হবে দেনমোহর আদায়ের দাবিতে মামলা। এই মামলা দায়ের করার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে স্ত্রীর।

আরো পড়ুনঃ ডিভোর্সের কত দিন পর বিয়ে করা যায়

কখন দেনমোহরের টাকা অর্ধেক পরিশোধ করা যায়

বিয়ের পরে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মিলনের আগে যদি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় অথবা স্বামীর মৃ-ত্যু হয়ে যায় তখন পুরো দেনমোহরের মধ্যে অর্ধেক দেনমোহর পরিশোধ করা যায়। বিয়ের পরে দৈ-হিক মিলন হয়ে গেলে, অথবা বিয়ের ৩-৪ দিন পরে স্বামী মারা গেলে বা ডিভোর্স হলে দেনমোহর পুরোপুরি পরিশোধ করতে হবে।

দেনমোহর সর্বনিম্ন কত টাকা

দেনমোহরের পরিমাণ ইসলামে কোন নির্ধারিত পরিমাণ বেঁধে দেওয়া হয়নি। রাসূল (সা:) বলেছিলেন, নিশ্চয়ই বরকতের দিক থেকে সর্বউত্তম, শান্তিময় ও গ্রহণযোগ্য বিয়ে হলো, যে বিয়ে সবচেয়ে অল্প খরচে সম্পাদিত হয়। তবে হানাফি মাজহাবের মতে বলা যায়, সর্বনিম্ন দেনমোহর দেওয়া যায় দশ দিরহাম অর্থাৎ ৩০.৬১৮ গ্রাম রূপা অথবা তার সমপরিমাণ টাকা।

এবং দেনমোহর নির্ধারণের সময় স্বামীর আর্থিক অবস্থার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বিত্ত্যবানরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী দেনমোহর নির্ধারণ করবে এবং যাদের জীবন জীবিকা সীমিত তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী দেনমোহন নির্ধারণ করা উচিত। নারী যেন তার ন্যায্য অধিকার সঠিকভাবে পায়, এতে করে স্বামীর সামর্থ্য যেরকমই থাকুক তার অবস্থান থেকে সেই অনুযায়ী দেনমোহর পরিশোধ করা উচিত।

আরো পড়ুনঃ divorce papers তালাক নামা ফরম ডাউনলোড

দেনমোহর ও কাবিননামা কি এক?

বিয়ের সময় কনের পক্ষ থেকে দাবিকৃত অর্থ বা সম্পদ, যা বরের আর্থিক অবস্থার উপর নির্ধারিত করা উচিত এবং বর তার স্ত্রীকে তা প্রদান করা বাধ্যতামূলক এটাই মূলত দেনমোহর। এবং কাবিননামা হচ্ছে, বিবাহ সম্পাদনের জন্য যে লিখিত চুক্তি করা হয় তাই কাবিননামা। বিবাহ বৈধ হওয়ার জন্য কাবিননামা বাধ্যতামূলক নয়, কাবিননামা একটি আইনি বাধ্যবাধকতা। স্ত্রীর ভরনপোষণ, প্রাপ্য দেনমোহর, সন্তানের পিতৃত্ব ইত্যাদির ক্ষেত্রে নিবন্ধিত কাবিননামা একটি আইনি দলিল।

সর্বশেষ কথা

দেনমোহরের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নারীকে সম্মান ও প্রকৃত মর্যাদা দেওয়া। বিত্তবানদের জন্য খুবই অল্প পরিমাণ দেনমোহর নির্ধারণ করা ঠিক নয়, যাতে স্ত্রীর মর্যাদার কোন ইঙ্গিত না থাকে এবং দেনমোহর এত অধিক পরিমাণও নির্ধারণ করা ঠিক নয়, যা পরিশোধ করা স্বামীর পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না।

স্বামীকে যেহেতু বাধ্যতামূলক দেনমোহর পরিশোধ করে দিতে হবে, তাই তার সামর্থ্য বিবেচনা করে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারিত হবে। কনের পক্ষ থেকে স্বামীর সামর্থের বাইরে দেনমোহরের পরিমাণ চাপিয়ে দেওয়া কোন ভাবেই উচিত নয়। নারীকে তার যথাযথ প্রাপ্য অধিকার ও সম্মানজনক দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করাই উত্তম।

আপনার মতামত জানান এখানে

0 কমেন্ট

আর্টিকেল সম্পর্কিত তথ্য জানতে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

কমেন্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. explore more
Ok, Go it!