আজকাল নরমাল ডেলিভারির তুলনায় সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদান বেশি হচ্ছে। এর কারণ হলো নরমাল ডেলিভারিতে একজন গর্ভবতী মাকে অনেকটা প্রসব বেদনা সহ্য করতে হয়। কিন্তু সে তুলনায় সিজারিয়ান অপারেশনে একজন গর্ভবতী মাকে বাচ্চা প্রসবের জন্য কোন ব্যথা অনুভব করতে হয় না।
(toc) #title=(সূচিপত্র)
তাই সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে অনেকেই নরমাল ডেলিভারির তুলনায় সিজারিয়ান অপারেশন কি বেছে নেন। তবে সিজারিয়ান অপারেশনের পর একজন মাকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তারমধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হল সিজার অপারেশনের রোগীর পেট ফুলে যাওয়া। আর অনেকেই এই পেটের মেদ কমাতে পারেন না।
তাই আজকের আর্টিকেলে আমি বলবো “সিজারের পর পেট কমানোর উপায়”, সিজারের পর পেটের দাগ কমানোর উপায় কি, সিজারের পর পেটের কালো দাগ কমানোর উপায়, সিজারের পর পেট ফুলে যায় কেন, সিজারের পর বেল্ট পড়ার নিয়ম ইত্যাদি।
সিজারের পর পেট ফুলে যায় কেন
সিজারের পর পেট কমানোর উপায় কি এ প্রশ্নটির উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে আগে জানতে হবে সিজারের পর পেট ফুলে যায় কেন?
আসলে সি সেকশনের পর একজন মা প্রথম কয়েক মাস শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল থাকে এবং বাচ্চাকে স্তন্যপান করানো, সন্তানের দেখাশোনা করা, সংসারের কাজ সবকিছু করতে গিয়ে তিনি তারদিকে একেবারে নজর দেন না।
একজন গর্ভবতী মা যখন গর্ভধারণ করে তখন তার দেহে যে ওজন থাকে তা বেড়ে গর্ভাবস্থায় সেই ওজনের ১০-১৫ কেজি বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই সি সেকশনের পর বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হলে তার পেট ও ফুলে যায়। সি সেকশনের পর অধিকাংশ মা-ই তার নিজের যত্ন কোন ভাবেই নেন না।
এসময় পেট ফুলাটা স্বাভাবিক। কিন্তু সিজারের পর পেট কমাতে হলে চিকিৎসকগণ বেশ কিছু ব্যায়াম করতে বলেন কিন্তু তারা সেগুলো করেন না। ফলে সিজারের পর তাদের পেট আরো ফুলে যায়।
তাছাড়া বাচ্চাকে স্তন্যপান করানোর জন্য অনেক মা-ই আছেন যারা অতিরিক্ত পরিমাণে খাবার খেয়ে থাকেন। এর ফলেও কিন্তু তাদের পেটের মেদ বেড়ে যায়। যার ফলে সিজারের পর পেট ফুলে যায়।
সিজারের পর পেট ফুলে যাওয়ার মূল কারণই হলো একজন মায়ের নিজের প্রতি সঠিক যত্ন না নেওয়া। সিজারের পর একজন মায়ের উচিত ডায়েট মেন্টেন করে খাবার গ্রহণ করা। কিন্তু তিনি তা করেন না ফলে তার দেহে অতিরিক্ত ওজন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, তার সাথে সাথে তার পেটেও ফুলতে থাকে।
আরো পড়ুনঃ সিজারের পর ইনফেকশন হলে করণীয়
সিজারের পর পেট কমানোর উপায়
সিজারের পর পেট কমানোর উপায় কি? এমন প্রশ্নে রয়েছে অনেক সমাধান। সি সেকশন বা সিজারিয়ান অপারেশনের পর অনেক মহিলারই পেট বেড়ে যায়। ফলে অনেকেই জানতে চান সিজারের পর পেট কমানোর উপায় কি? নিচের উপায় গুলো অবলম্বন করলে সিজারের পর পেট কমানো যাবেঃ
১। বাচ্চাকে বেশি করে স্তনপান করানো
সিজারের পর দেহের ওজন অথবা পেট কমানোর অন্যতম উপায় হলো নিজের শিশুটিকে বেশি বেশি করে দুধ পান করানো। এর মাধ্যমে আপনার দেহের অতিরিক্ত ওজনের পাশাপাশি পেটের মেদ কমবে।
২। সিজার অপারেশনের কিছুদিন পর থেকে শরীর চর্চা করা
অনেক গর্ভবতী মা-ই আছেন সি সেকশনের পর পুরোপুরি বিছানার সাথে লেগে যায়। তবে এমনটি করা একদম ঠিক নয়। সিজারের পর পেটের মেদ কমাতে হলে অবশ্যই কিছু শারীরিক ব্যয়াম নিয়মিত করতে হবে। এতে করে দেহের অতিরিক্ত ওজনের সাথে পেটের মেদ কমে পেটের ফোলা ভাব কমে যাবে। তাই নিয়মিত ৪৫ মিনিট হলেও কিছু না কিছু ব্যায়াম করুন।
৩। পেটের মধ্যে বেল্ট ব্যবহার করা
সিজারের পর চিকিৎসকরা অধিকাংশ নারীকেই পরামর্শ দিয়ে থাকেন বেল্ট ব্যবহার করতে। কিন্তু অনেকেই সেটি করেন না। যার ফলে সিজারের পর পেট অনেক বেশি মোটা হয়ে যায়। তাই সিজারের পর পেট কমাতে অবশ্যই পেটের মধ্যে বেল্ট ব্যবহার করুন। শুধুমাত্র গোসল এবং ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া সর্বক্ষণ পেটে বেল্ট ব্যবহার করুন।
৪। পরিমাণ মতো খাবার খান
সিজারিয়ান অপারেশন হলে অনেকেই মনে করেন একজন মাকে অনেক বেশি বেশি খেতে হবে। তাছাড়া বেশি করে না খেলে সন্তান দুধ পাবে না এমন ধারণা আছে অনেকের। তবে এমনটি একদম ঠিক নয়।
মা এবং সন্তানের সুস্থতায় একজন মায়ের উচিত অবশ্যই খাদ্য খাওয়া। তবে সেটি যেন হয় পরিমাণ মতো। তাই সিজারিয়ান অপারেশনের পর দেহের অতিরিক্ত ওজন কমাতে এবং পেটের মেদ কমাতে অবশ্যই একটি ডায়েট চার্ট তৈরি করুন, এবং সে অনুযায়ী খাবার খান।
৫। ফাস্টফুড ও মিষ্টি জাতীয় খাবার ত্যাগ করুন
অনেকেই আছেন বাইরের খাবার প্রচুর পছন্দ করেন এবং প্রচুর বাইরে খান। কিন্তু সিজারিয়ান অপারেশনের পর এমনটা একদম ঠিক নয়। বাইরের ফাস্টফুডে অতিরিক্ত তেল এবং মসলা থাকে। যার ফলে সেগুলো দেহে অতিরিক্ত চর্বি তৈরি করে।
পাশাপাশি অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবারও দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে। তাই সিজারিয়ান অপারেশনের পর পেট কমাতে অবশ্যই ফাস্টফুড ও মিষ্টি জাতীয় খাবার ত্যাগ করবেন।
সিজারের পর পেট কমানোর উপায় কি? আশা করি এ প্রশ্নের উত্তর এতক্ষণে পেয়ে গেছেন। সুতরাং চেষ্টা করবেন এই উপায় গুলো মেনে চলতে। এতে খুব দ্রুতই আপনার পেটের মেদ কমে যাবে।
আরো পড়ুনঃ সিজারের পর মায়ের খাবার তালিকা
সিজারের পর পেটের দাগ কমানোর উপায়
সিজারের পর অনেকের পেট ফুলে যাওয়ার সাথে সাথে পেটে নানা রকম দাগ পড়ে যায়। ফলে অনেকেই চান এই দাগ দূর করতে। আসুন জেনে নেই সিজারের পর পেটের দাগ কমানোর উপায় গুলো:
১) অ্যালোভেরা জেল ব্যবহার করা
বিশেষজ্ঞদের মতে অ্যালোভেরা জেল একজন মায়ের জন্য খুবই উপকারী। দেহের কোন অংশে পোড়া দাগ থাকলে, কিংবা কোন ক্ষতের দাগ থাকলে সেখানে এলোভেরা জেল ব্যবহার করলে সে দাগ খুব তাড়াতাড়ি দূর হতে থাকে।
২) ভিটামিন ই অয়েল ব্যবহার করা
এটি এমন একটি তেল, যেটি দেহ ত্বকের একেবারে নীচের অংশে কোলাজেন প্রোটিনের বিভাজন ঘটাতে অধিক কার্যকরী। ফলেকোলাজেনের বিভাজনের কারনে ত্বকের নীচে নতুন করে স্তর তৈরি হয়। আর এতে করে সিজারের পর পেটে পরে যাওয়া দাগ মিলিয়ে যায়। তাই নিয়মিত এই তেল সিজারের জায়গায় ব্যবহার করুন।
৩) সিজারের কাটা জায়গায় মধু ব্যবহার করুন
সর্দি কাশি অথবা যে কোন রোগের উপশমে মধু বেশ কার্যকরী। তার পাশাপাশি শরীর যেকোনো কাটা দাগ দূর করতেও এটি অত্যন্ত উপকারী। এতে আছে অ্যান্টিসেপটিক এর বৈশিষ্ট্য। তাই সিজারের পর কাটা দাগ দূর করতে অবশ্যই নিয়মিত মধু মাখুন।
৪) চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু মলম মাখুন ও ওষুধ সেবন করুন। এতে করে অনেকটাই কাটা অংশের দাগ কমে যাবে।
আরো পড়ুনঃ প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট কোনটা ভালো
সিজারের পর পেটের কালো দাগ কমানোর উপায়
অনেকেরই সি সেকশনের পর পেটের মধ্যে সেলাইয়ের জায়গায় কালো দাগ পড়ে যায়। এতে পেট দেখতে খুব বিশ্রী দেখায়। অনেকেই পেটের কালো দাগ দূর করতে চান। সেক্ষেত্রে আপনারা কাটা জায়গায় কোকোয়া বাটার ইউজ করতে পারেন। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা সিজারের পর পেটের কালো দাগ দূর করতে অনেকটা সাহায্য করে।
তাছাড়া সিজারের পর পেটের কালো দাগ দূর করতে আলুর রস ব্যবহার করতে পারেন। কারন আলুর রসে আছে ন্যাচারাল ব্লিচ উপাদান। যেটি কালো দাগ দূর করতে অধিক সহায়তা করে। তাই কালো দাগ দূর করতে এটিও ব্যবহার করতে পারেন।
পেটের কালো দাগ দূর করতে ব্যবহার করুন চা পাতা। কারণ কোকোয়া বাটারের মতো চা পাতাতে ও আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যা যেকোনো দাগ দূর করতে সক্ষম। তাই সিজারের পর পেটের কালো দাগ দূর করতে ব্যবহার করুন চা পাতা।
আরো পড়ুনঃ কোন পিল সবচেয়ে ভালো? ইমারজেন্সি পিল কোনটা ভালো
সিজারের পর বেল্ট পরার নিয়ম - সিজারের পর বেল্ট পড়ার নিয়ম
সিজারের পর পেট কমাতে চিকিৎসকগণ সিজারিয়ান অপারেশনের রোগীকে বেল্ট করতে বলেন। কিন্তু অনেকেই বেল্ট ব্যবহার করেন না। যার ফলে পেট ঝুলে যায়, ফুলে যায়, পেটের মেদ অনেক বেড়ে যায়।
অনেকেই আছেন সিজারের বেল্ট পড়ার নিয়ম জানেন না। সিজারের কতদিন পর থেকে বেল্ট পড়তে হয় তাও জানেন না। বা কতটুকু সময় বেল্ট পড়ে থাকবেন সেটিও অনেকেই জানেন না।
সিজারিয়ান অপারেশনের ২-৩ সপ্তাহ পর বেল্ট পড়া শুরু করলে ভালো হয়। সেক্ষেত্রে আপনাকে বেল্ট পড়তে হবে পেটের চামড়ার সাথে মিলিয়ে। পাজামা কিংবা পোশাকের উপর বেল্ট পড়লে চলবে না এবং সর্বক্ষণ বেল্ট ব্যবহার করতে হবে শুধুমাত্র ঘুমানো এবং গোসল ব্যতীত সময়টুকু বাদে।
আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় সালোয়ার পড়ার নিয়ম
মহিলাদের পেটের মেদ কমানোর উপায়
আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের সিজারিয়ান অপারেশন হয়নি কিন্তু পেটের মেদ অনেকটা বেড়ে গেছে। তারা চায় পেটের মেদ কমাতে। বেশ কিছু উপায় অবলম্বন করলেই মহিলাদের পেটের মেদ কমে যাবে। যেমন:
- নিয়মিত ব্যায়াম করাঃ পেটের মেদ কমানোর জন্য বেশ কিছু ব্যায়াম রয়েছে। যে ব্যায়ামগুলো নিয়মিত করলে আপনার পেটের মেদ কমে যাবে।
- প্রতিদিন সকালে গরম পানির সাথে লেবুর রস মিশিয়ে খাওয়াঃ লেবুর রসের সাথে গরম পানি মিশিয়ে খেলে দেহের অতিরিক্ত মেদ ঝরে যায়। তাই মহিলাদের পেটের মেদ কমাতে লেবুর গরম পানি অত্যন্ত উপকারী।
- কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বেশি না খাওয়াঃ কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার দেহের ওজন বৃদ্ধি করে। তাই মহিলাদের পেটের মেদ কমাতে হলে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার পরিমাণমতো খেতে হবে। অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া যাবেনা।
- বাহিরের তৈলাক্ত ও ফাস্টফুড খাবার খাওয়া যাবেনাঃ তৈলাক্ত জাতীয় খাবার দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি এটি শরীরের ওজন ও বৃদ্ধি করে। তাই পেটের মেদ কমাতে হলে অবশ্যই তৈলাক্ত ফাস্টফুড খাবার ত্যাগ করতে হবে।
- একটি ডায়েট চার্ট তৈরি করে খাবার গ্রহণ করাঃ যখনই কোন মহিলা দেখবেন তার পেটের মেদ অতিরিক্ত পরিমাণে বেড়ে যাচ্ছে তখনই তাকে একটি ডায়েট চার্ট তৈরি করে নিতে হবে। যেটি তার ওজন কমাতে অনেক সাহায্য করবে। ডায়েট চার্ট মেইনটেইন করে খাবার গ্রহণ করলে পেটের মেদ অনেকটা কমে আসবে।
আরো পড়ুনঃ নরমাল ডেলিভারি হওয়ার উপায়
উপসংহার
সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদান হওয়া মানেই একজন মায়ের পুরোপুরি বলি হয়ে যাওয়া নয়। সি সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর অনেক মা-ই নিজের নিজের যত্ন নেওয়া একেবারেই ভুলে যায়। যার ফলেই বাড়তে থাকে ওজন, বাড়তে থাকে পেট।
তাই সন্তান পালনের পাশাপাশি একজন মায়েরও উচিত নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া। প্রতিদিন কিছু না কিছু শারীরিক ব্যায়াম করা, অধিক পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার ও পানি গ্রহণ করা। ফলে মা যেমন সুস্থ থাকবে তেমনি তার শরীরের ওজনও বাড়বে না। পাশাপাশি পেটের মেদও বাড়বে না।
আর্টিকেল সম্পর্কিত তথ্য জানতে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।