“থাইরয়েড” এই শব্দটির সাথে আমরা কম বেশ সবাই পরিচিত। আমাদের মধ্যে অনেকেই থাইরয়েড রোগে আক্রান্ত। মূলত থাইরয়েড হলো এক ধরনের গ্রন্থির নাম, যা মানবদেহে গলার নিচের দিকের অংশে বিদ্যমান থাকে। আমাদের বাংলাদেশে এই থাইরয়েড রোগীর সংখ্যা অসংখ্য। তাছাড়া আমাদের দেশে অন্য যেকোন বড় রোগের রোগীদের তুলনায় এই থাইরয়েড রোগীর সংখ্যাই পরিমাণে অনেক বেশি।
থাইরয়েড গ্রন্থির মূল কাজই হলো মানব দেহে হরমোন সিক্রেট করা। যেটি শরীরের কাজকে পুরোপুরি পরিবর্তন এবং নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর বর্তমানে এই থাইরয়েড গ্রন্থির নানান সমস্যা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম একটি হরমোনজনিত সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বলা চলে হরমোন জনিত সমস্যার ডায়াবেটিকসের পরই এই থাইরয়েড এর অবস্থান। আজকের লেখায় আলোচনা করতে যাচ্ছি, থাইরয়েড হলে কি কি সমস্যা হয়, থাইরয়েড কি খেলে ভালো হয়, থাইরয়েড কমানোর উপায় ইত্যাদি নানান বিষয়। চলুন তাহলে শুরু করি।
(toc) #title=(এক নজরে সম্পূর্ণ লেখা পড়ুন)
থাইরয়েড হলে কি কি সমস্যা হয়
থাইরয়েড এর সমস্যায় যারা ভুগছেন তারা অনেকেই জানতে চান থাইরয়েড কি খেলে ভালো হয়। আসলে থাইরয়েড মূলত একটি হরমোন জনিত সমস্যা। যা অনেকটা ডায়াবেটিসের মতোই। তবে থাইরয়েড কি খেলে ভালো হয়? এমন প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আগে জানতে হবে থাইরয়েড হলে কি কি সমস্যা হয়। আসুন জেনে নেই থাইরয়েড হলে মানব শরীরে কি কি সমস্যা দেখা দিতে পারেঃ
- থাইরয়েড হলে সর্বপ্রথম যে সমস্যাটি দেখা দেয় সেটি হল ক্লান্তি লাগা।
- অধিকাংশ সময়ই ঠান্ডা লেগে থাকবে।
- প্রচুর পরিমাণে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিবে।
- ত্বক ধীরে ধীরে শুষ্ক হয়ে যাবে।
- থাইরয়েড এর অন্যতম সমস্যা হলো দিন দিন ওজন বৃদ্ধি হওয়া।
- চেহারা প্রচুর পরিমাণে ফুলে যাওয়া।
- গলার স্বর এর বদল ঘটা।
- শরীরে প্রচুর দুর্বলতা অনুভব করা।
- দেহের পেশিতে প্রচুর পরিমাণে ব্যথা অনুভব করা।
- মেনস্ট্রুরাল সার্কেল বা মাসিকের চক্র হঠাৎ বদলে যাওয়া।
- চুল পরতে পরতে পাতলা হয়ে যাওয়া।
- অধিকাংশ সময় ডিপ্রেশনে ভোগা।
- যেকোনো বিষয় মনে রাখতে অনেক সমস্যা হওয়া।
- হৃদগতি বা হৃদস্পন্দন ধীর হয়ে পরা।
একজন থাইরয়েড রোগী সাধারণত উপরোক্ত সমস্যাগুলোই ভুগে থাকেন। তাছাড়া কারো যদি এই উপসর্গ গুলো দেখা দেয়, তাহলে বুঝতে হবে তিনি থাইরয়েড রোগে আক্রান্ত। উক্ত সমস্যা গুলো দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
আরো পড়ুনঃ কি খেলে টিউমার ভালো হয়
থাইরয়েড কি ভালো হয়
যারা থাইরয়েড রোগে আক্রান্ত কিংবা যারা থাইরয়েড রোগের নাম শুনেছেন, তাদের অনেকের মনেই জানার কৌতূহল থাকে যে থাইরয়েড কি ভালো হয়? অর্থাৎ থাইরয়েড কি দীর্ঘস্থায়ী কোন রোগ? নাকি চিকিৎসা নিলেই থাইরয়েড রোগ ভালো হয়ে যায়?
থাইরয়েড রোগ হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা। যা মূলত দেহের থাইরয়েড গ্রন্থিকে নানা ভাবে প্রভাবিত করে থাকে। আর ঘাড়ে অবস্থিত একটি ছোট প্রজাপতি আকৃতির গ্রন্থি আছে যেটি শরীরের সকল প্রকার বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে এমন ধরনের হরমোন তৈরি করে থাকে।
থাইরয়েড রোগ এর সবচেয়ে সাধারণ ধরন হলো হাইপারথাইরয়েডিজম এবং হাইপোথাইরয়েডিজম এই দুটি। আসলে যদিও থাইরয়েড রোগ পুরোপুরি ভাবে নিরাময় করা সম্ভব না। তবে থাইরয়েড রোগী চাইলে সঠিক চিকিৎসার ও নানা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই এই রোগকে ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারবে।
অর্থাৎ মূল কথা হল ডায়বেটিসকে যেমন পুরোপুরি ভাবে নিরাময় করা সম্ভব নয়, একইভাবে থাইরয়েড রোগ ও নিরাময় করা যায় না। তবে সঠিক চিকিৎসা ও কিছু বিষয় মেনে চললে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
আরো পড়ুনঃ কি খেলে আলসার ভালো হয়
থাইরয়েড কি খেলে ভালো হয়
থাইরয়েড কি খেলে ভালো হয়? যারা থাইরয়েড রোগী আছেন কিংবা যারা থাইরয়েড রোগী নন তারা সবাই কম বেশ এই প্রশ্নটির উত্তর জানতে চাই। থাইরয়েড যেহেতু একটি হরমোন জনিত সমস্যা সেক্ষেত্রে অবশ্যই থাইরয়েড রোগীকে পুষ্টি কর সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। থাইরয়েড রোগীকে এমন কিছু খাবার গ্রহণ করতে হবে যা তিনি খেয়ে হজম করতে পারেন এবং সেই খাবারই রয়েছে অধিক পুষ্টিগুণ। আসুন জেনে নেই থাইরয়েড কি খেলে ভালো হয়। অর্থাৎ যে খাবারগুলো খেলে আপনার থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে থাকবে:
- শীতকালীন ফল কমলা
- আয়োডিনযুক্ত লবণ
- কমলা লেবু অথবা বাতাবি লেবু
- অশ্বগন্ধা
- সবুজ শাক এবং তাজা শাকসবজি
- সবুজ মরিচ, টমেটো, পেঁয়াজ ও রসুন খেলে থাইরয়েড ভালো হয়
- সামুদ্রিক মাছ
- মিষ্টি আলু
- মসুরের ডাল
- ডিম
- চর্বিহীন সকল ধরনের মাংস
- ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার যেমন: মাছ, ডিম, গাজর, দুধ ও মাশরুম খান
- বাদাম
- থাইরয়েড গ্রন্থির মসৃণ কার্যকারিতার জন্য সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ বাদাম এবং সাধারণ বাদাম খাওয়া উপকারী
- ছোলা
- মটরশুঁটি
- গরুর দুধ, দই ও পনির পরিমাণ মতো খান
মোটামুটি উপরোক্ত খাবারগুলো খেলে থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আশা করি থাইরয়েড কি খেলে ভালো হয় এই প্রশ্নের উত্তরটি এত্তক্ষণে পেয়ে গেছেন।
তবে থাইরয়েড হলে অবশ্যই কিছু খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার, অস্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত এবং প্রক্রিয়াজাত উপাদানের পরিমাণ বেশি থাকে এমন সব খাবার অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
এবং যারা হাইপোথাইরয়েডে আক্রান্ত তারা ভুলেও প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস বা মাছ, যেকোনো ভাজা পোড়া খাবার এসব খেতে পারবেন না। থাইরয়েড কি খেলে ভালো হয় জানতে হলে সবচেয়ে ভালো হয় একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে কথা বলা তিনি আপনাকে এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত বুঝিয়ে বলতে সক্ষম হবে।
আরো পড়ুনঃ ছোলা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
ঘরোয়া পদ্ধতিতে থাইরয়েড কমানোর উপায় - থাইরয়েড কমানোর ঘরোয়া উপায়
থাইরয়েড ডায়াবেটিসের মতোই একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা বা রোগ। তাই একে পুরোপুরি ভাবে নিরাময় করা না গেলেও কিছু উপায় অবলম্বন করার মাধ্যমে থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। থাইরয়েড কমানোর উপায় বা থাইরয়েড কমানোর ঘরোয়া উপায় নিচে দেওয়া হলো:
- থাইরয়েড রোগী অ্যাপেল সিডার ভিনেগার খেতে পারেন। কারন এতে আছে এমন কিছু পুষ্টিগুণ যা থাইরয়েড উৎপাদনে সাহায্য করে। পাশাপাশি এটি দেহের মেদ ঝরাতেও অনেকটা সাহায্য করে এবং এটি শরীর থেকে যাবতীয় টক্সিন বের করে দেয়।
- আয়োডিনযুক্ত লবণ: থায়রয়েড সমস্যা দূর করতে পরিমাণ মতো আয়োডিনযুক্ত লবণ খান।
- নারকেল তেল: নারকেল তেল তো অত্যন্ত উপকারী একটি উপাদান। আর এই নারকেল তেলে থাকা ফ্যাটি এসিড থাইরয়েড গ্রন্থিকে কাজ করতে সহায়তা করে। তাই রান্নায় সানফ্লাওয়ার কিংবা সয়াবিন তেলের বদলে নারকেল তেল দিয়ে রান্না করতে পারেন।
- ভিটামিন বি সমৃদ্ধ খাবার: ভিটামিন বি এর মধ্যে পড়ে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, আখরোট। ভিটামিন বি তে থাকা পুষ্টিগুণ থাইরয়েডের নানামুখি সমস্যার সাথে লড়াই করতে সক্ষম। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভিটামিন বি সমৃদ্ধ খাবার রাখুন।
- আদা খান: আদায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম এবং আদা শরীরের বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। তাই চাইলেই আপনি এক দু কোয়া আদা এমনিতেই খেয়ে ফেলতে পারেন।
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন: শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করলে এমনিতেই শরীর ভালো থাকে। আর যারা থাইরয়েডের সমস্যায় ভুগছেন তারা যদি নিয়মিত ব্যায়াম করেন তাহলে থাইরয়েড অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
সুতরাং থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে উপরোক্ত ঘরোয়া উপায় গুলো অবলম্বন করে দেখতে পারেন। ফলাফল আপনি নিজেই প্রত্যক্ষ করতে পারবেন।
আরো পড়ুনঃ নুডুলস এর উপকারিতা ও অপকারিতা
থাইরয়েড কি খেলে খাওয়া যাবে না
থাইরয়েড কি খেলে ভালো হয় জানার পর এবার আমরা জানব থাইরয়েড থাকলে কোন খাবারগুলো আমাদের খাওয়া উচিত হবে নয়।
- সয়াবিন কিংবা সয়াবিন জাত সকল ধরনের খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। কিছু গবেষণায় জানা গেছে, সয়াবিন জাতীয় খাবার খাওয়ার কারণে থাইরয়েডের ওষুধ সঠিক মতো কাজ করেনা। তাই আপনার উচিত সয়াবিন, সয়ার দুধ এবং টফুর মতো খাবার গুলো পরিমাণ মতো খাওয়া।
- থাইরয়েডের সমস্যা হলে ব্রোকলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি খাওয়া যাবে না। অনেকেই আছেন যারা শরীরের ওজন কমানোর জন্য ফুলকপি অথবা কেল পাতার মতো শাকসবজি ডায়েটে রাখেন। তবে থাইরয়েড সমস্যা থাকলে এই খাবার গুলো খাবেন না।
- থাইরয়েড সমস্যা হলে কফি খাওয়া সীমিত করুন। কারণ অত্যাধিক ক্যাফেইনে থাইরয়েডের সমস্যা বৃদ্ধি করতে পারে। তবে হা আমি একবারে ছেড়ে দেওয়ার দরকার নেই। কফি সকাল বেলা খেতে পারেন। তবে হ্যাঁ দিনে একবার খাওয়াই ভালো।
- মিষ্টিজাতীয় যেকোনো খাবার আপনার ডায়েট চার্ট থেকে থেকে বাদ দিয়ে দিন। যদি কারো থাইরয়েডের সমস্যা থাকে তবে তার ওজন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তি লাভের জন্য মিষ্টিজাতীয় খাবার বাদ দেয়াই ভালো।
- প্যাকটজাত যেসকল খাবার আছে সেগুলা কম খেতে হবে। কারণ এই সকল খাবার গুলোতে লবণ ও চিনির এবং তেলের পরিমাণ বেশি থাকে। যা ওজন দ্রুত বৃদ্ধি করতে পারে। তাই উচিত এই ধরনের প্যাকেটজাত খাবার এড়িয়ে চলা। প্রসেস করা খাবারও এড়িয়ে চলবেন।
- বেশিরভাগ ডাক্তারের পরামর্শ এই যে, দুগ্ধজাত খাবার গুলো শরীরে হরমোনের তারতম্যকে আরো বৃদ্ধি করে। তাই দুধ, মাখন, চিজের মতো খাবারগুলো পরিমাণ মতো খেতে হবে বা সম্ভব হলে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
আরো পড়ুনঃ টেস্টোস্টেরন হরমোন বৃদ্ধির খাবার তালিকা
থাইরয়েড হলে কি বাচ্চা হয় না
থাইরয়েড নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেকেরই একটি ধারণা রয়েছে যে, "থাইরয়েড হলে কি বাচ্চা হয় না"। আসলে এই ধরনের ঠিক কতটুকু যুক্তিযুক্ত। এটি কি আদৌ সত্য?
থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা হলো মূলত দুই ধরনের। এর মধ্যে একটি হচ্ছে হাইপো থাইরয়েড এবং আরেকটি হচ্ছে হাইপার থাইরয়েড। যারা হাইপোথাইরয়েড রোগে ভুগেন তাদের শরীরে মূলত থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কম।
আর এই ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণের জন্য ডিম্বাণু গঠন ও পরিপক্কতার বেশ কিছু সমস্যার কারণে এই রোগীরদের গর্ভধারণে জন্য বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়। যার ফলে অনেকেই দেখা যায় গর্ভধারণ করতে পারেন না। তবে থাইরয়েড হলে যে একেবারেই মা হওয়া যাবে না এমন বিষয়টি ভুল। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে রাখলে অবশ্যই মা হওয়া সম্ভব।
উপসংহার
থাইরয়েড যদিও কোন মরণব্যাধি রোগ না, কিন্তু সঠিকভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে একজন থাইরয়েড রোগীকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেহেতু এই রোগটি পুরোপুরি ভাবে নিরাময় করা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে কি কি করলে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব সেই দিকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং সুস্থ থাকতে হলে যতটা সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। সঠিক সময়ে খাবার, বিশ্রাম শরীর চর্চা ইত্যাদি মেনে চললেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে "থাইরয়েড"।