আল্ট্রাসনোগ্রাম চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্যতম প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে শরীরের ভেতরের অবস্থা ছবি বা ভিডিও আকারে দেখা যায়। একে আলট্রাসাউন্ড, আলট্রাসনোগ্রাফি বা সনোগ্রাফিও বলে।
শরীরের অভ্যন্তরে নানা জটিলতা যেমন হার্ট, র ক্তনালী, মূত্রথলী, পেলভিক অর্গান, জরায়ু ইত্যাদির অবস্থা জানতে আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করা হয়। তবে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসায়।
কারণ গর্ভাবস্থায় গর্ভের শিশু কেমন আছে, কি অবস্থায় আছে এসব তথ্য জানার ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আরও একটি তথ্য জানতে সবচেয়ে বেশি এই পরীক্ষাটি করা হয় তাহলো গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে। তবে এই পরীক্ষাটির রিপোর্ট সবাই বোঝে না। তাই আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায় কি তা জানাবো আজকের আর্টিকেলে।
(toc) #title=(এক নজরে সম্পূর্ণ লেখা পড়ুন)
আলট্রাসনোগ্রাফি কাকে বলে?
আলট্রাসনোগ্রাফি হলো মানব দেহের অভ্যন্তরের ছবি তোলার পদ্ধতি। মেডিকেল টেস্টের জন্য শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে রোগীর দেহের ভেতরের ইমেজ দেখার পদ্ধতিকে আলট্রাসনোগ্রাফি বলে।
মানব শরীরে একটি ছোট ডিভাইসের মাধ্যমে আল্ট্রাসাউন্ড বা শব্দ পাঠানো হয়। যা সাধারণ মানুষ কানে শোনে না। এর তরঙ্গ কম্পাংক ২-২০ মেগাহার্টজ।
এই শব্দ যতবেশি জোরে হয় ততবেশি ছবি পরিষ্কার হবে। তবে শব্দ শরীরের ভেতর পৌঁছতে পৌঁছতে ত্বক ও মাংসপেশী তা শুষে ফেলে। এজন্য কম মাত্রার শব্দ প্রেরণ করা হয় যেন তা শরীরের ভেতরে পৌঁছতে পারে। এতে অবশ্য ছবি বেশি পরিষ্কার হয় না।
এরপর দেহের ভেতরকার তোলা ছবিটি একটি যন্ত্রের সাথে সংযুক্ত মনিটরে দেখা যায়। এর মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত ভিডিও করা যায়। আর চিকিৎসক সেটি দেখে রোগ বা শরীরের অবস্থা জানতে পারেন। যে যন্ত্রের মাধ্যমে এই পরীক্ষাটি করা হয় সেটাকে বলে আলট্রাসনোগ্রাফ যন্ত্র। আর যিনি এটা দিয়ে পরীক্ষা করেন তাকে বলে সনোগ্রাফার।
আরো পড়ুন: আয়রন ট্যাবলেট এর উপকারিতা
আলট্রাসনোগ্রাফি কেন করে
আলট্রাসনোগ্রাফি করে মূলত রোগ নির্ণয় করার জন্য। চিকিৎসক রোগীর দেহের অভ্যন্তরীণ অবস্থা জানতে এই পরীক্ষাটি করে থাকে। কারো হার্টের সমস্যা হলে হার্ট দেখার জন্য, পিত্তথলীতে সমস্যা হলে তা দেখার জন্য, মূত্রথলীর রোগ নির্ণয়ে, থাইরয়েড গ্রন্থি, জরায়ু, গর্ভাশয় প্রভৃতি অঙ্গের সমস্যাগুলো নির্ণয় করতে আলট্রাসনোগ্রাফি করা হয়।
তবে আলট্রাসনোগ্রাফি সবচেয়ে জনপ্রিয় গর্ভবতী নারীর পেটের সন্তানের অবস্থা দেখার জন্য। এজন্য নারীদের উপরই বেশি এই পরীক্ষাটি হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে পেটের ভেতর ভ্রূণ জরায়ুতে সঠিকভাবে স্থাপিত হয়েছে কি না, কতটুকু গঠিত হলো, শিশুর মস্তিষ্ক ও হাড় গঠিত হয়েছে কি না, কোন পজিশনে আছে ইত্যাদি জানতে পারি।
গর্ভাবস্থায় কখন আলট্রাসনোগ্রাফি করে
নারী গর্ভবতী হলেই আলট্রাসনোগ্রাফি করতে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তবে গর্ভবতী হলে একজন নারীর শরীর ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। এক এক জনের নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। আবার গর্ভের শিশুটিও সঠিকভাবে বিকশিত হচ্ছে কি না তাও জানার দরকার হয়। তখন চিকিৎসক গর্ভবতীকে চেকআপ করে নির্ধারণ করেন কখন কখন আলট্রাসনোগ্রাফি করতে হবে। এক্ষেত্রে সাধারণত ৩ টি পরীক্ষা করতে বলা হয়।
১ম আলট্রাসনোগ্রাফি
বিশেষ করে মাসিক বন্ধ হওয়ার ৬-১০ সপ্তাহ বা ২ মাসের মধ্যে প্রথম আলট্রাসনোগ্রাফি করতে বলেন।কারণ এর আগে ভ্রূণ গঠিত হয় না তাই বোঝাও যায় না কিছু। তাই মাসিক বন্ধ হওয়ার ২ মাসের দিকে এই পরীক্ষাটি করতে হয়।
২য় আলট্রাসনোগ্রাফি
এরপরের আলট্রাসনোগ্রাফি গর্ভবতী হওয়ার ১৮-২২ সপ্তাহ বা ৫/৬ মাসের দিকে করতে বলা হয়। তখন শিশু মাতৃগর্ভে আকৃতি পায়। তার শারীরিক অবস্থা ঠিক আছে কি না এসব জানা যায়।
৩য় আলট্রাসনোগ্রাফি
শেষ বা ৩ নম্বর আলট্রাসনোগ্রাফি করা হয় ৩৬-৩৮ সপ্তাহে বা ৯ মাসের দিকে। কারণ তখন গর্ভাবস্থার শেষ দিক থাকে। গর্ভবতী এসময় নানান জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে। শিশুর পজিশনও কোন অবস্থায় আছে, নরমাল ডেলিভারি হবে নাকি সিজার করাতে হবে এসব কিছু তখন এই পরীক্ষা করার মাধ্যমে জানা যায়।
আরো পড়ুন: বাচ্চাদের দুধ কোনটা ভালো
আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায়
আলট্রাসনোগ্রাফি করালে হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট দেওয়া হয়। এই রিপোর্টে গর্ভবতী নারীর শরীরের অবস্থা ও বাচ্চার অবস্থা কেমন তা উল্লেখ থাকে। আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায় কি তা দেওয়া হলো:
- Fetal Number: মাতৃগর্ভে কয়টি ভ্রুণ আছে তা বোঝায় এই ফেটাল নম্বর। যদি ১ টি বাচ্চা থাকে তো Single লেখা থাকবে। আর জমজ বাচ্চা হলে ডাবল লেখা থাকবে।
- Fetal Position: মাতৃগর্ভে ভ্রুণ কোন অবস্থানে আছে তা বুঝা যায় এর মাধ্যমে।
- Fetal Heart Rate: গর্ভের ভ্রূণের হার্টবিট বুঝা যায় এর দ্বারা।
- Amniotic Fluid Index: নারীর গর্ভে এ্যামনিওটিক ফ্লুইড নামে একটি তরল থাকে। সেটি সাধারণত ৫-২৫ cm হলে স্বাভাবিক হয়। এই রিপোর্ট দিয়ে কত cm ফ্লুইড আছে তা জানা যায়।
- Placenta: গর্ভাবস্থায় গর্ভবতী নারীর জরায়ুতে প্লাসেন্টা বিকশিত হয়। থলির মতো এই অঙ্গটি গর্ভস্থ বিকাশমান শিশুকে খাদ্য এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে। এটি শিশুর র ক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থও দূর করে।
- Fetal Anatomic Survey: এই পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভস্থ ভ্রূণের শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গঠিত হয়েছে কি না, ঠিক আছে কি না তা বুঝা যায়।
- GA-Gestational Age: গর্ভাবস্থার বয়স কত তা জানা যায় এর দ্বারা।
- BPD-Biparietal Diameter: ভ্রূণের ব্যস পরিমাপ করার প্যারামিটার এটি।
- HC-Head Circumference: ভ্রূণের মাথার পরিমাপ নির্ধারণ করা যায় এর মাধ্যমে।
- AC-Abdominal Circumference: ভ্রূণের পেটের পরিমাপ নির্ধারণ করা যায় এর মাধ্যমে।
- FL-Femur Length: ভ্রূণের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করা যায় এর দ্বারা।
আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট দেখে কীভাবে বুঝবেন ছেলে না মেয়ে?
আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট পাওয়ার জন্য সব দম্পতি মুখিয়ে থাকে জানার জন্য যে ছেলে না মেয়ে হবে।এজন্য রিপোর্ট বুঝা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায় জেনে নিন।
রিপোর্টের ডেসক্রিপশনে জেন্ডার m/boy লেখা থাকলে সাধারণত স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে গর্ভের সন্তান ছেলে। এছাড়া অনেক রিপোর্টে একটি বৃত্তের সাথে যুক্ত তীর চিহ্নের মাধ্যমেও বুঝা যায় ছেলে হবে।
রিপোর্টের ডেসক্রিপশনে জেন্ডার f/girl লেখা থাকলে সাধারণত স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে গর্ভের সন্তান মেয়ে। এছাড়া রিপোর্টে একটি বৃত্তের সাথে যুক্ত যোগ চিহ্নের মাধ্যমেও বুঝা যায় মেয়ে হবে। তবে কখনও কখনও জেন্ডার নির্দিষ্ট করা হয় না। তখন রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ থাকে না।
আরো পড়ুন: জিংক বি ট্যাবলেট খেলে কি মোটা হয়
লিঙ্গ নির্ণয় আলট্রাসনোগ্রাম কোন সপ্তাহে হয়?
অনেকেই আলট্রাসনোগ্রাফি করতে চায় সন্তানের লিঙ্গ নির্ণয় করার জন্য। কিন্তু লিঙ্গ নির্ণয় আলট্রাসনোগ্রাম কোন সপ্তাহে হয় তা আমরা জানি না। সাধারণত প্রথম ২ মাসে প্রথম আলট্রাসনোগ্রাফি করা হয়। কিন্তু তখন ভ্রূণ অবস্থায় থাকায় শিশুর আকৃতি বুঝা যায় না। এজন্য পরের আলট্রাসনোগ্রাফি যেটা ১৮-২২ সপ্তাহে করতে বলা হয় তখন কিন্তু কাঙ্ক্ষিত তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ লিঙ্গ ছেলে না মেয়ে তা বুঝা যায়। তবে মাঝে মাঝে শিশু এমন অবস্থায় পেঁচিয়ে থাকে যে তার লিঙ্গ ছবিতে স্পষ্ট হয় না। সেক্ষেত্রে ডেলিভারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
আল্ট্রাসনোগ্রাফি কি গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর?
আল্ট্রাসনোগ্রাফি কি গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর? এই প্রশ্নটি সবার মনেই জাগতে পারে। আসলে এই পরীক্ষাটি করার সময় কোনও রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় না। কারণ এতে শুধু আল্ট্রাসাউন্ড ব্যবহার করা হয়। আর ২-২০ মেগাহার্টজের শব্দ ক্ষতিকর নয়। তাই গর্ভের শিশু ও মায়ের জন্য এই পরীক্ষাটি নিরাপদ।
আল্ট্রাসনোগ্রাম ফলাফল ফিরে পেতে কত সময় লাগে?
আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা করার পর সবাই অপেক্ষা করে কখন রিপোর্ট পাওয়া যাবে। আসলে এই পরীক্ষা করার সাথে সাথে ইমেজ পাওয়া যায়। তবে ইমেজ চিকিৎসক পেলেও পুরো তথ্য বুঝতে ও রিপোর্ট সাজাতে কিছুটা সময় লাগে। এজন্য সাধারণত এই পরীক্ষা করার ২৪ ঘণ্টা পরে রিপোর্টটি পাওয়া যাবে।
আরো পড়ুন: বিড়াল কামড়ালে কত দিনের মধ্যে টিকা দিতে হয়
শেষ কথা
আজকের আর্টিকেলটি ছিলো আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায়। আলট্রাসনোগ্রাফি নিয়ে নানান তথ্য শেয়ার করা হয়েছে। আলট্রাসনোগ্রাফি কি, কেন করে, রিপোর্ট বুঝার উপায়, লিঙ্গ নির্ণয় কোন সপ্তাহে হয়, এই পরীক্ষা ক্ষতিকর কি না ইত্যাদি তথ্য জানা যাবে আর্টিকেলটি থেকে। আর ভালো লাগলে কমেন্ট ও শেয়ার করবেন।
আর্টিকেল সম্পর্কিত তথ্য জানতে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।