কৃষি চাষাবাদ করেন অথচ “ইমিডাক্লোপ্রিড” গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করেন নাই, এমন মানুষ খুবই কম পাওয়া যাবে। তাই আজকে আমরা “ইমিডাক্লোপ্রিড” বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য সহজ ভাষায় আপনাদের সাথে শেয়ার করব। আশা করি এখানে উল্লেখ করা তথ্যগুলো আপনাদের কৃষির ব্যবহারিক ক্ষেত্রে খুবই কাজে লাগবে।
আবার, ইমিডাক্লোপ্রিড এর কাজ কি তা অনেকের অজানা। চাষাবাদের জন্য “ইমিডাক্লোপ্রিড” একটি বহুল প্রচলিত কীটনাশক। অধিকাংশ কৃষক বিভিন্ন ধরনের ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে।
তাই এই আর্টিকেলটিতে ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক সিনজেনটা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য সহজভাবে আপনাদের উপস্থাপন করব। আশা করি এই তথ্যগুলো আপনাদের চাষাবাদে ক্ষেত্রে অনেক কাজে লাগবে। চলুন তাহলে ইমিডাক্লোপ্রিড সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
(toc) #title=(এক নজরে সম্পূর্ণ লেখা পড়ুন)
ইমিডাক্লোপ্রিড কি
নিওনিকোটিনয়েড গ্রুপের যে কীটনাশক কীটপতঙ্গের স্নায়ুতন্ত্রের উপর কাজ করে বিষক্রিয়া শুরু করে তাকে ইমিডাক্লোপ্রিড করে।
ইমিডাক্লোপ্রিড এর কাজ কি
শোষক শ্রেণির কীটপতঙ্গ (যারা গাছের রস খেয়ে জীবন ধারন করে) থেকে ফসলকে রক্ষা করায় ইমিডাক্লোপ্রিড প্রধান কাজ। একটিই একমাত্র কীটনাশক যা দিয়ে আপনি কৃষিক্ষেত্রের প্রায় অর্ধেক পোকার বিস্তার রোধ করতে পারবেন।
আপনার কি জানেন, গাছের পাতা কুঁকড়ে যাওয়ার কারণ। কারণটি হলো গাছে শোষক পোকার আক্রমণ। আর এই পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক অনেক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
আপনার ফসলে বা কোনো গাছে যদি জাব পোকা, সাদা মাছি, শোষক পোকার আক্রমণ হয় তবে আপনি ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন। একসময় ইমিডাক্লোপ্রিড ছিলো বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত কীটনাশক। বর্তমানেও তা অব্যাহত রয়েছে।
আরো পড়ুনঃ সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশকের নাম
ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক যেভাবে কাজ করে
ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশকগুলো কয়েকটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় কাজ করে। নিচে প্রক্রিয়া গুলো দেওয়া হলোঃ
ইমিডাক্লোপ্রিড উদ্ভিদ বা গাছের প্রয়োগ করলে সম্পূর্ণ গাছে তা ছড়িয়ে পড়ে। পাতা কাণ্ড ও ডালপালা সমস্ত জায়গায় কীটনাশকটি পৌঁছে যায়। যার ফলে পোকামাকড় উদ্ভিদের যেকোন অংশ থেকে রস খেতে চাইলে রসের মাধ্যমে বিষ পোকামাকড়ের দেহে প্রবেশ করে।
ইমিডাক্লোপ্রিড প্রয়োগের ফলে পোকা মাকড়ের স্নায়ুর স্বাভাবিক সংকেত পাঠানোর ক্ষমতাকে ব্যাহত হয় এবং স্নায়ুতন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। পোকামাকড় তার প্রতিটি অঙ্গের কাজ করার ক্ষমতা হারায় এবং একপর্যায়ে অসাড় হয়ে মারা যায়।
যদি পোকা মাকড় উদ্ভিদ থেকে রস শোষণ না করে তবুও এই কীটনাশকের ফলে পোকা মাকড়ের মৃত্যু হয়। উদ্ভিদের যে অংশে কীটনাশকটি প্রয়োগ করা হয়েছে সেই অংশের সাথে পোকার গায়ে স্পর্শ হলেই পোকামাকড় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের যেকোন কীটনাশক ফসলে প্রয়োগ করা হলে এবং সেই ফসল যদি পোকামাকড় খায় তা পাকস্থলীতে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং পোকা মারা যায়।
ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশকগুলো আরেকটি বিশেষ ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে ফসলে যদি কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় এবং কীটনাশক যদি উদ্ভিদের পাতার উপর পড়ে তাহলে পাতার এপিডার্মিস ভেদ করে এ কীটনাশক পাতার নিচে পৌঁছাতে পারে যার। ফলে পাতার নিচের লুকিয়ে থাকা পোকা গুলো বিষক্রিয়ার শিকার হয়।
আরো পড়ুনঃ ভুট্টার মাজরা পোকা দমনে কীটনাশক ১০০% কার্যকরী
ইমিডাক্লোপ্রিড কোন কোন পোকা দমন করে
ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের যেকোন কীটনাশক অনেক প্রজাতির অসংখ্য পোকা দমন করতে সক্ষম। তবে সবগুলো নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই নিচে কিছু প্রজাতির পোকা নিয়ে আলোচনা করা হলো যেগুলো সহজে ইমিডাক্লোপ্রিড কীটনাশ দ্বারা দমন করা সম্ভব।
এফিড (Aphid): এই ধরনের পোকা ক্ষুদ্র হয়ে থাকে এবং গাছের রস এদের প্রধান খাবার। সাধারণত এই পোকাদের গাছের উকুন বলা হয়ে থাকে। অনেকে আবার সাদামাছি, কালো মাছি বা সবুজ মাছি ও বলে থাকে। সাধারণত এদের আক্রমন বেশি হয়ে থাকে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায়।
থ্রিপস পোকাঃ উকুন জাতীয় এই পোকা সকল ধরনের মাঠ ফসল, মসলা জাতীয় ফসল, অথবা যেকোন সবজি ফসলে আক্রমণ করে থাকে।
জ্যাসিডঃ জ্যাসিড বা শ্যামা পোকা দমনেও ইমিডাক্লোপ্রিড ভালো কাজ করে।
কারেন্ট পোকাঃ ইমিডাক্লোপ্রিড প্রবাহমান গুনসম্পন্ন হওয়ায় কারেন্ট পোকাও দমন করতে সক্ষম।
ফলের মাছি পোকাঃ লাউ, কুমড়া জাতীয় সবজি এবং অন্যান্য ফলের রস খেয়ে মাছি পোকা যেহেতু বেঁচে থাকে, তাই তাদের দমনের জন্যও এটি ভালো কাজ করে।
জাব পোকাঃ এই পোকাটি আমাদের অতি পরিচিত। জাব পোকা দমনে ইমিডাক্লোপ্রিড বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
শস্য | পোকার ধরন |
---|---|
ধান | বাদামী গাছ ফড়িং, পামরী পোকা |
তুলা | জাব পোকা, জেসিড ও সাদা মাছি/গুটি পোকা |
চা | উইপোকা |
আখ | উইপোকা |
তাছাড়াও হপার, মিলিবাগ, প্ল্যান্ট পার্পারস, বিটল সহ অনেক অচেনা অচেনা পোকা দমনে ইমিডাক্লোরপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক কাজ করে।
আরো পড়ুনঃ ধানের মাজরা পোকা দমনের কীটনাশক
ইমিডাক্লোপ্রিড কেন ব্যবহার করবেন
সাধারণত শোষক পোকারা প্রতিদিন তাদের শরীরের ওজনের ৩ থেকে ২০ গুণ রস শোষণ করে। কোন পোকা আবার ৮০ গুন পর্যন্ত রস শোষন করে থাকে। গাছের থেকে সমস্ত খাদ্য ও রস চুষে নেওয়ার ফলে গাছ মারা যায়।
তাই ছোট পোঁকা ভেবে এটাকে মোটেও হালকা হবে নেওয়া উচিত না। কেননা এটা ধীরে ধীরে সংক্রমন বৃদ্ধির মাধ্যমে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। তাই শোষক পোকার উপস্থিতিতে টের পেলে ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক প্রয়োগ করলে ভালো সুফল পাওয়া যাবে।
এই কীটনাশকটি বাজারে সুলভ মূল্যে পাওয়া যায় এবং সহজলভ্য তাছাড়া এর কার্যকারিতা অনেক। তাই যেকোন পোকামাকড়ের সংক্রমণ দেখা দিলে প্রথমে এই কীটনাশকটির কথা মাথায় আসে।
ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশকের বৈশিষ্ট্য
প্রতিক্রিয়াঃ অন্যান্য কীটনাশকের সাথে ইমিডাক্লোপ্রিড এর মিশ্রণ তৈরি করলে খারাপ বিক্রিয়া করে না। তাই অন্যান্য কীটনাশকের সাথে এটিকে সহজে ব্যবহার করা যায়।
বিষাক্ততাঃ এটি খুব দ্রুত কাজ করে তবে মাটি ও পানি দূষণ তুলনামূলক কম করে। প্রাণী ভেদে এর বিষাক্ততা বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যেমন -কীটপতঙ্গ বা অমেরুদন্ডী প্রাণীদের জন্য এটা মারাত্মকভাবে বিষাক্ত। অন্যদিকে মানুষ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জন্য বিষাক্ততা কিছুটা কম লক্ষণীয়।
অকার্যকারিতাঃ এটি ল্যাদা জাতীয় পোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা সহ অন্যান্য কুরে খাওয়া পোকা দমনে সফলভাবে কাজ করতে পারে না। তাই এগুলো দমনে ইমিডাক্লোপ্রিড উপযুক্ত নয়।
ইমিডাক্লোপ্রিড প্রয়োগ বিধি
ব্যবহারের মাত্রাঃ ইমিডাক্লোরপ্রিড 20 ml লিকুইড সাধারণত মাঠ ফসলে ও সবজিতে প্রতি লিটার পানিতে 0.5 ml অনুপাতে ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হয়। তবে অবস্থা ভেদেএবং গাছের ধরন অনুসারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহারের মাত্রায় পরিবর্তন করা হয়।
কোম্পানি ভিত্তিক ইমিডাক্লোরপ্রিড গ্রুপের কীটনাশকের বাণিজ্যিক নামের তালিকা
বহুল প্রচলিত এই কীটনাশকটি বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন নামে বাজারজাত করে থাকে।
কোম্পানির নাম | বাণিজ্যিক নাম |
---|---|
এসিআই | টিডো/ টিডো প্লাস |
অটো ক্রপ কেয়ার | ইমিটাফ |
ইনতেফা | জাদীদ |
মিমপেক্স | ক্যানোপি |
দি লিমিট এগ্রো | লিমিডোর |
হেকেম বাংলাদেশ | প্রিমিয়ার/ক্যাপচার |
জেনেটিকা | কৃষক বন্ধু |
গ্লোবাল এগ্রোভেট | সাপ্টা |
ম্যাকডোনাল্ড | গেইন |
ক্যানোপি প্লাস ৭০ ডব্লিউ জি
ইমিডাক্লোরপ্রিড গ্রুপের একটি কীটনাশকের নাম ক্যানোপি প্লাস ৭০ ডাব্লিউ জি। এর মুল উপাদান ইমিডাক্লোপ্রিড। বেগুনের জাব পোকা, ধানের বাদামি গাছ ফড়িং, আমের হুপার, তুলার জাব পোকা ও জ্যাসিড দমনে কার্যকারি ভূমিকা রাখে এই কীটনাশকটি।
আশা করি, এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে আপনারা ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। ইমিডাক্লোপ্রিড কি, ইমিডাক্লোপ্রিডের কাজ কি, এর গুণাগুণ, বৈশিষ্ট্য, প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যবহারবিক বিধি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেয়েছেন।
আর্টিকেল সম্পর্কিত তথ্য জানতে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।