কবুতরের মাংসের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইছেন? কবুতরের মাংস খাওয়ার উপকারিতা জানলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। কবুতর একটি গৃহপালিত পাখি। যা প্রাণিজ আমিষের একটি সহজলভ্য উৎস। কেননা এর মধ্যে রয়েছে অসাধারণ কিছু পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা আমাদের দেহের অনেক রোগ নিরাময় এবং দেহের বৃদ্ধির জন্য সহায়তা করে থাকে।
লোকমুখে একটি প্রচলিত কথা আছে তা হল কবুতরের মাংসে থাকা পুষ্টিগুণ ৯টি মুরগির পুষ্টির সমান। গবেষণায় জানা গেছে, অন্যান্য মাংসের তুলনায় কবুতর এর মাংসে প্রায় ২ থেকে ২৪ শতাংশ বেশি পরিমাণে প্রোটিন উপস্থিত আছে এবং এতে ফ্যাটের পরিমাণ খুবই সামান্য প্রায় ১ শতাংশ। তবে চলুন কবুতরের মাংস আমাদের শরীরের জন্য কতটা উপযোগী সে সম্পর্কে এ টু জেট জেনে নেয়া যাক।
(toc) #title=(পোষ্ট সূচিপত্র)
কবুতরের মাংসের উপকারিতা
কবুতরের মাংসে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও ভিটামিন আছে। যা শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও অস্ত্রোপচারের পর রোগীর ক্ষতকে পুনরুদ্ধার এবং দ্রুত সময়ে নিরাময়ের জন্য ভালো ভুমিকা পালন করে কবুতরের মাংস।
চাইনিজ চিকিৎসা বিজ্ঞান মতে; কবুতরের মাংস খাওয়ার কারনে লিভারের উন্নতি সাধন হয় এবং কিডনিকে শক্তিশালী করে তুলে। এছাড়াও রক্ত সুস্থ করে তোলার পাশাপাশি কবুতরের মাংস শরীরের তরল উপাদানের মান উন্নয়নে ভুমিকা পালন করে।
কবুতরের মাংসের উপকারিতা গুলো হল:
- শরীরে রক্ত বৃদ্ধি করে
- কবুতরের মাংস চর্বিমুক্ত প্রোটিনের উৎস
- কোলেস্টেরলের মাত্রা কম
- ক্ষত নিরাময় করতে সাহায্য করে
- পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে
- রোগ থেকে সেরে উঠতে ভালো কাজ করে
- স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে
- লিভার ও কিডনির জন্য উপকারী
- কবুতরের মাংস নরম ও সুস্বাদু
- শরীরের দূর্বলতা দূর করে
১. রক্ত বৃদ্ধি করে: কবুতরের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকায় এটি আমাদের দেহের রক্ত তৈরিতে সহায়তা করে। বিশেষত কবুতরের বাচ্চার মাংস রক্ত বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই যারা পুষ্টিহীনতা ও রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন তারা পুষ্টি উপাদান হিসেবে এবং রক্তবৃদ্ধিকারী খাবার হিসেবে কবুতরের বাচ্চা খেতে পারেন।
২. চর্বিমুক্ত প্রোটিনের উৎস: শরীরে সুস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রোটিন একটি অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান।কবুতরের চর্বির পরিমাণ থাকে মাত্র ১%। আমরা গরু ছাগল মুরগি থেকে প্রোটিন পাই। তবে এগুলোতে চর্বি থাকায় অনেকে এগুলোকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তাই যারা কম চর্বিযুক্ত খাবার খেতে চান তারা খাদ্য তালিকায় কবুতরের মাংস রাখতে পারেন।
৩. কোলেস্টেরলের মাত্রা কম: কবুতরের মাংসে কোলেস্টেরলের পরিমাণ অনেক কম থাকে। অন্যদিকে গরু, ছাগল, মুরগি এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টেরল থাকে। বিশেষ করে গরু এবং ছাগলে। তাই কম কোলেস্টেরল যুক্ত প্রোটিন পেতে হলে কবুতরের মাংস খেতে হবে।
৪. ক্ষত নিরাময় কাজ করে: কবুতরের রয়েছে কোলাজেন নামে একটি পুষ্টি উপাদান যা ক্ষত নিরাময়ের বিশেষ ভূমিকা রাখে। ডাক্তার অপারেশনের রোগীদের কবুতরের মাংস খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কেননা এটি দ্রুত ক্ষত নিরাময়ে সহায়তা করে। তাছাড়া এটি আপনার ত্বকে সতেজতা বজায় রাখে।
৫. পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে: কবুতরের মাংস খেলে বেশ কিছু পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। যেমন- প্রোটিন, আয়রন, ফসফরাস, ভিটামিন, জিঙ্ক, ভিটামিন এ, ভিটামিন-সি, ভিটামিন বি, ভিটামিন বি-৬, ভিটামিন বি ১২, ভিটামিন ডি, রিবোফ্লাভিন, সেলেনিয়াম, নিয়োসিন ইত্যাদি।
৬. দ্রুত রোগ থেকে সেরে উঠতে কাজ করে: সাধারণত অসুস্থ ব্যক্তিদের দ্রুত রোগ নিরাময়ের জন্য কবুতরের মাংস খাওয়ানো হয়ে থাকে। অপুষ্টি বা দুর্বলতার জনিত রোগ থেকে সেরে উঠতে অনেক পুষ্টির প্রয়োজন হয়। আর এই পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে কবুতরের মাংস। তাই কবুতরের মাংস খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং রোগী দ্রুত সরে ওঠে। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ সবার জন্যই এই খাবারটি উপযুক্ত।
আরো পড়ুনঃ আলকুশি বীজের উপকারিতা ও অপকারিতা
বলা হয়ে থাকে একটি কবুতরের মধ্যে প্রায় নয়টি মুরগির সমান পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে। তাই অসুস্থ কোনো রোগীকে দেখতে গেলে ফলমূল নেওয়ার সাথে সাথে এক জোড়া কবুতর নিয়ে যাবেন।
৭. স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে: কবুতরের মাংসে থাকা পুষ্টি উপাদান আমাদের মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপকারী। কেননা এটি আমাদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৮. লিভার ও কিডনির জন্য উপকারী: কবুতরের মাংসের পুষ্টি উপাদান আমাদের লিভার ও কিডনিকে ভালো রাখে ও আরো শক্তিশালী করে তুলে।
কবুতরের বাচ্চা খাওয়ার উপকারিতা
কবুতরের মাংসে রয়েছে প্রোটিন যা শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এর পাশাপাশি বিপাক ক্রিয়া ভালো হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, চুল এবং নখের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, শরীর পূর্বের তুলনায় আরো বেশি এনজাইম তৈরি করতে সক্ষম হয় ফলে ক্লান্তি কমে।
কবুতরের মাংসে বেশি পরিমাণে খনিজ উপাদান রয়েছে। বিভিন্ন খনিজ উপাদান গুলোরর মধ্যে অন্যতম হল সেলেনিয়াম। যা ফ্রি র্যাডিক্যাল থেকে আমাদের শরীরকে রক্ষা করে, রিউম্যাটিড আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি কমায়, থাইরয়েডের কার্যকারিতা বাড়ায়, ত্বক এবং চুলের বিবর্ণতা রোধ করে, পেশি ব্যথা কমায়। এমনকি ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকিও হ্রাস পায় নিয়মিত কবুতরের মাংস খাওয়ার কারনে।
কবুতর এর মাংসে যথেষ্ট পরিমাণে জিঙ্ক আছে। যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে, বিষণ্নতা কমায় ও শিশুদের বিকাশ উন্নত করে, আঁচিলের মতো চর্মরোগ প্রতিরোধ করে, দ্রুত ক্ষত নিরাময় করে, কোষ বৃদ্ধি সমর্থন করে, রক্তে শর্করার মাত্রা ও ক্ষুধা কমাতে, গন্ধের অনুভূতি বাড়াতে, বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।
কবুতরের মাংস আমাদের অঙ্গ এবং রক্তের জন্য অনেক ভালো। কেননা এর প্রোটিন এবং খনিজ লিভার ও কিডনির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে, স্মৃতিশক্তি ও বুদ্ধি বাড়ায়, রক্তচাপ হ্রাস করে, ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ রাখে।
কবুতরের মাংস ব্যতীত এর লিভার এবং হাড়ের অনেক উপকারীতা আছে। কবুতরের লিভারে থাকে কোলিন যা শরীরে ভালো কোলেস্টেরলেল পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং এথেরোস্ক্লেরোসিস প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে (একটি রোগ যাতে ধমনীতে ফলক তৈরি হয়)।
কবুতরের মাংসের হাড়ের মধ্যে এমন একটি পদার্থ রয়েছে যা ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে কাজ করে।
এক নজরে কবুতরের মাংস খাওয়ার উপকারিতা
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
- পেশি, দাঁত ও হাড়ের গঠনে সাহায্য করে
- ত্বক/চুল ও নখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
- শরীরের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে
- ক্ষত নিরাময় করে।
- দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে।
- ক্লান্তি বা শরীরের অসাড়তা দূর করে
- রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করে।
- স্মৃতিশক্তি বাড়ায়।
- অবসাদ/ মানসিক বিভ্রান্তি/ হতাশা দূর করে।
কবুতরের মাংস খাওয়ার অপকারিতা
যারা হাই পেশার অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপের রোগী তাদের কবুতরের মাংস এড়িয়ে চলা উচিত। কেননা এটি উচ্চ রক্তচাপকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। যাদের কবুতরের মাংসে এলার্জি রয়েছে তারা এটিকে এড়িয়ে যেতে পারেন। কেননা এলার্জি জনিত কোন খাবার খাওয়া উচিত নয় কিংবা খাবার খাওয়ার এলার্জি ওষুধ খেয়ে নিতে হবে।
কবুতরের মাংস স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হলেও এর চামড়া বেশি চর্বিযুক্ত। তাই উচিত নয় অতিরিক্ত কবুতরের মাংস খাওয়া। অবশ্যই কবুতরের মাংস পরিমাণ মেপে তবেই খান।
গর্ভাবস্থায় কবুতরের মাংস খাওয়ার উপকারিতা
স্বাদ গুনে ভরপুর কবুতরের মাংসের পুষ্টি উপাদান তালিকা লক্ষ্ করলে আমরা অনেক পুষ্টি উপাদানের নাম দেখতে পাই। গর্ভবতী মা এবং তার সন্তানের পুষ্টির যোগান এবং সন্তানের বিকাশের কবুতরের মাংস অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যে সকল গর্ভবতী মায়েরা শারীরিকভাবে দুর্বল বা রক্তস্বল্পতায় ভুগছে চিকিৎকরা তাদের কবুতরের মাংস খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এতে করে মা এবং শিশু ও উভয়ই পুষ্টি পায়। যে সকল গর্ভবতীদের সিজারের বাচ্চা হয় তাদের সিজারের ক্ষত দ্রুত সারানোর কবুতরের মাংস একটি আদর্শ খাবার।
কেন কবুতরের মাংস খাবেন
- অনেক ধরনের পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে
- বাজারে সহজলভ্য ও স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায়
- সহজে রান্না করা যায় এবং অল্পতেই সিদ্ধ হয়ে যায়
- মাত্র এক মাসের কবুতরের বাচ্চাকে রান্না করে খাওয়া যায়।
কবুতরের বাচ্চা কতদিন পর খাওয়ার উপযোগী হয়
কবুতরের বাচ্চা খুব দ্রুত খাওয়ার উপযোগী হয়। কবুতরের বাচ্চার বয়স ২৫ থেকে ৩০ দিন হলে তার মধ্যে কবুতরের বাচ্চা খেয়ে ফেলতে হবে। তাছাড়া একটু বড় হয়ে গেলে কবুতরের পাখা বড় হয়ে যাবে এবং কবুতর উড়ে যাবে। যারা বাড়িতে কবুতর পালন করে তারা যদি ৩০ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে খেতে চান তখন চেষ্টা করেন কবুতরের পাখার পালক কিছুটা কেটে রাখার জন্য যার ফলে এরা উড়ে যেতে পারবে না।
৫ থেকে ৬ মাস বয়সী কবুতরেরা ডিম পেড়ে থাকে। প্রতি মাসে একবার করে ডিম পাড়ে এবং কবুতরের বাচ্চাদের বয়সে এক মাস হলেই আমরা বাচ্চাগুলোকে খেতে পারি।
যেখানে একটা দেশি মুরগির বাচ্চাকে খেতে হলে আমাদের কমপক্ষে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়। সেখানে মাত্র এক মাসেই আমরা একটা পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে কবুতরের মাংস পাচ্ছি। তাই আমাদের খাদ্য তালিকায় এটিকে রাখা যায়।
আরো পড়ুনঃ ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
আমরা বর্তমানে পুষ্টি না অপুষ্টির পেছনে ছুটছি। লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন আমরা এক মাস বয়সী কবুতর কিনে খেতে চায় না। অথচ ৪০ দিন বয়সের ব্রয়লার মুরগির ঠিকই খায়। যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। আমরা শুধু দেখছি কম টাকায় কোথায় বেশি মাংস পাব। কিন্তু এটা দেখছি না যে কোথায় আমরা বেশি পুষ্টি পাব।
আপনার বাড়িতে কোন রোগী থাকলে কোনো ছোট বাচ্চা থাকলে অথবা বয়স্ক মানুষ থাকলে মাসে একবার হলেও কবুতর কেনার চেষ্টা করবেন। এতে আপনার পরিবারের পুষ্টির অভাব পূরণ হবে।
কবুতরের মাংস খাওয়ার বিষয়ে সতর্কতা
আমরা জানি সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ দিনের কবুতরের বাচ্চা গুলোকে মাংস করে খাওয়া যায়। কিন্তু বাচ্চাগুলো ছোট হাওয়ায় তা অনেক সময় ভালোভাবে পরিষ্কার করা যায় না। লোম অনেকটা চামড়ার মধ্যে থেকে যায়। কেউ কেউ আবার এ অপরিষ্কার চামড়া না ফেলে রান্না করে খেয়ে নেয়। যার ফলে ডায়রিয়া সহ আরো নানা ধরনের পেটের সমস্যা হতে পারে। সুতরাং যদি কবুতরের লোম পরিষ্কার করার সময় তা সঠিকভাবে পরিষ্কার করা সম্ভব না হয় তাহলে চামড়া ফেলে দিতে হবে।
আশা করি আজকের এই আর্টিকেল এর মাধ্যমে আপনারা কবুতরের মাংসের উপকারিতা ও অপকারিতা, গর্ভবতী মায়েদের কবুতরের মাংস খাওয়ার উপকারিতা এবং কবুতরের মাংসের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা পেয়েছেন। কবুতরের মাংস সম্পর্কে জানার পাশাপাশি আরো জানতে পারেন বরই পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা।
আর্টিকেল সম্পর্কিত তথ্য জানতে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।