উট হলো মরুভূমির জাহাজ। আর উটের দুধ যেন তরল সোনা। উটের দুধের উপকারিতা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবে। অসাধারণ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন উটের দুধ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। তবে উটের দুধ কেন এত দামি এই প্রশ্ন অনেকেই করেন।
তাই এই আর্টিকেলটিতে উটের দুধ খাওয়ার উপকারিতা এবং উটের দুধের দাম এত বেশি কেন, উটের দুধ কোথায় পাওয়া যায় এ বিষয়ে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি।
বাড়িতে ডায়াবেটিসের কি রোগী আছে, গরুর দুধের ল্যাকটোজে কি আপনার এলার্জি আছে, আপনার কি কোনো আত্মীয় অটিজমে আক্রান্ত, আপনি কি কম চর্বিযুক্ত খাবার খেতে পছন্দ করেন, তাহলে আপনার জন্য একটি উত্তম খাদ্য হলো উটের দুধ।
(toc) #title=(পোষ্ট সূচিপত্র)
উটের দুধের উপকারিতা
উটের দুধের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, আয়রন এবং ভিটামিন সি রয়েছে। উটের দুধে পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন থাকার কারণে এই দুধ নিয়মিত খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে যায়। টাইপ ১ ও টাইপ ২ ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে উটের দুধ।
উটের দুধে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন এবং অন্য অর্গানিক কম্পাউন্ড থাকায় এই দুধ খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। উটের দুধে আয়রন বেশি থাকার ফলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে। অ্যানিমিয়ার রোগীদের জন্য উটের দুধ অত্যন্ত উপকারী। উটের দুধ নিয়মিত ভাবে খেলে ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হৃদযন্ত্র ভালো থাকে।
নিম্নে উটের দুধের উপকারিতা বিস্তারিত তুলে ধরা হলোঃ
- উটের দুধ এলার্জি মুক্ত
- অন্ত্রের রোগ নিরাময় করে
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
- ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য উপকারী
- হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে
- ত্বক সুন্দর রাখতে কাজ করে
- পুষ্টিগুণে ভরপুর
- অটিস্টিকের জন্য উপকারী
১. উটের দুধ এলার্জি মুক্ত
যাদের গরুর দুধে এলার্জি রয়েছে তাদের জন্য একটি উত্তম খাদ্য হলো উটের দুধ। গরুর দুধ অত্যন্ত পুষ্টিকর উপাদান কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে গরুর দুধে এলার্জি দেখা দেয়। যার ফলে অনেকেই দুধের পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়।
কিন্তু উটের দুধ খেলে কারো অ্যালার্জি হয় না। যাদের গরুর দুধে এলার্জি রয়েছে তারা গরুর দুধের বিকল্প হিসেবে উটের দুধকে খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন। উটের দুধে থাকা বিটা-কেসিন মানুষের জন্য বেশি হজমযোগ্য এবং কম অ্যালার্জেনিক।
২. অন্ত্রের রোগ নিরাময় করে
উটের দুধের রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিভাইরাল বৈশিষ্ট্য, যা অন্ত্রের রোগ যেমন- ডায়রিয়া, পেটের আলসার এবং অন্ত্রের প্রদাহের চিকিৎসায় সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে উটের দুধ ডায়রিয়ার সমস্যা সমাধানেও কাজ করে।
হজমের সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের জন্য উটের দুধ একটি উত্তম খাদ্য। উটের দুধে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এতে প্রোবায়োটিক উপাদানও থাকে। এই প্রোবায়োটিক উপাদান খাদ্য হজমে ক্ষেত্রে কাজ করে।
৩. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কার্যকারিতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ এই দুধে উপস্থিত রয়েছে। উটের দুধে উচ্চমাত্রার মিনারেলের পাশাপাশি ইমুইনোগ্লোবিন নামক এক ধরনের অ্যান্টিবডি থাকে যা ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস ধ্বংসে করে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
৪. ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য উপকারী
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে উটের দুধ, রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে এবং টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন গ্রহণ ৩০% কমাতে সহায়ক। উটের দুধে চিনির মাত্রা অনেক কম।
৫. হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে
উটের দুধে ইনসুলিনের মতো প্রোটিন থাকে, যা আমাদের হৃদপিণ্ড ও শরীরের জন্য রক্ত শোষণকে ভালো করে। শুধু তাই নয়, এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য হৃৎপিণ্ডকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে কেননা এটি স্বাস্থ্যকর চর্বি যেমন লং-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড, লিনোলিক অ্যাসিড, পলিআনস্যাচুরেটেড অ্যাসিড ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ।
৬. ত্বক সুন্দর রাখতে কাজ করে
এটিতে উচ্চ পরিমাণে আলফা-হাইড্রক্সিল অ্যাসিড (AHAs) রয়েছে যা আমাদের মৃত ত্বককে এক্সফোলিয়েট করতে সাহায্য করে, যা কোষের টার্নওভার রেট বাড়িয়ে দেয়। ফলে মৃত চামড়ার সরে গিয়ে নতুন ত্বকে উজ্জ্বলতা দেখা যায়। উটের দুধে সাবান, ক্রিম ইত্যাদি আকারে পাওয়া যায় যা ময়শ্চারাইজড এবং উজ্জ্বল ত্বক বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৭. পুষ্টিগুণে ভরপুর
বিশেষজ্ঞদের মতে,দিনে ১২০ মিলি উটের দুধ খেলে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়ামের প্রায় ৫ শতাংশ এবং দৈনিক থায়ামিনের প্রায় ২৯ শতাংশ সহজে পাওয়া সম্ভব। উটের দুধে ভিটামিন সি সহ আরো বেশ কয়েকটি ভিটামিন রয়েছে। যেমন- ভিটামিন এ, বি, ডি, এবং ই। উটের দুধে আরো রয়েছে বিশেষ কিছু খনিজ উপাদান রয়েছে। যেমন -পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, দস্তা, আয়রন।
৮. অটিস্টিকের জন্য উপকারী
উটের দুধ অটিস্টিক ব্যক্তিদের জন্য অনেক উপকারী। যেসব বাচ্চা অটিজম এ আক্রান্ত, তাদের গরুর দুধের পরির্বতে উটের দুধ খাইয়ে দেখতে পারেন যে তাদের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসে কিনা। বিদেশ থেকে ফ্রোজেন উটের দুধ আনার ক্ষেত্রে লিটার প্রতি ২-৩ হাজার টাকা পড়তে পারে। তবে বাংলাদেশের যেসব জায়গায় উটের খামার রয়েছে সেখানে আপনি সহজে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে উঠে দুধ পেয়ে যাবেন।
এছাড়াও উটের দুধের আরও বেশ কিছু উপকারিতা হয়েছে। যেমন-
- উটের দুধে চর্বির পরিমান অনেক কম থাকে। গরুর দুধের তুলনায় উটের দুধে চর্বির পরিমাণ প্রায় অর্ধেক এবং ভিটামিন সি এর পরিমাণ প্রায় ১০ গুন বেশি।
- উটের দুধে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি যা আমাদের কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
- প্রোটিন সমৃদ্ধ এই দুধে কোলেস্টেরলের মাত্রা অনেক কম।
- এতে নির্দিষ্ট এনজাইম রয়েছে যা দুধের প্রোটিন দ্রুত হজম করতে সাহায্য করে।
- এই দুধে উচ্চ মাত্রায় ল্যাক্টোফেরিন, ইম্যুনোগ্লোবিউলিন,ল্যাক্টোপারঅক্সাইড এবং লাইসোজোম রয়েছে। সেই কারণে প্রাচীন কাল থেকেই উটের দুধ, পরিপাক তন্ত্রেরে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য ব্যবহার হয়ে আসছে।
উটের দুধ কেন এতো দামি
উটের দুধের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য হওয়ার কারণে এত দাম বেশি। উটের দুধের উপকারিতা অনেক। তাই বিশ্বব্যাপী এর চাহিদা অনেক কিন্তু সে তুলনায় দুধ উৎপাদন নগণ্য মাত্র। পৃথিবীর হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি দেশে উটের খামার রয়েছে।
প্রথম আলো দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদ অনুযায়ী প্রতি বছর বিশ্বে গরুর দুধ উৎপাদিত হয় প্রায় ৬০ কোটি টন। অন্যদিকে উটের দুধ উৎপাদিত হয় বছরে মাত্র ৩০ লাখ টন।
যেখানে গরুর দুধ থেকে উটের দুধের চাহিদা বেশি সেখানে উটের দুধের যোগান গরুর দুধের ধারে কাছেও নেই। তাই দাম এত বেশি।
একটি উট দিনে সাধারণত ৬ থেকে ৭ লিটার দুধ দেয়। অন্যদিকে গরু কিন্তু এই সংখ্যার দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পরিমাণ পর্যন্ত দুধ দিতে সক্ষম। তাই গরুর দুধের তুলনায় উটের দুধের দাম বেশি।
উটের খাবারের দাম বেশি। উট প্রায় শুষ্ক অঞ্চলে পাওয়া যায়। যেখানে তাদের খাদ্য এবং পানির উৎস সীমিত হতে পারে, ফলে উট পালন করার জন্য খরচ বেশি হয়।
উটের দুধের দাম কত
বিদেশ থেকে উটের দুধ আমদানি করার ক্ষেত্রে দামের কিছুটা তারতম্য হতে পারে। তবে যে দেশ থেকে আমদানি করেন না কেন বর্তমান বাজারে উটের দুধের দাম প্রতি লিটার প্রায় ৩ হাজার থেকে ৩৫০০ হাজার টাকা। তবে বাংলাদেশ হাতে গোনা কয়েকটি উটের খামার রয়েছে যেখানে আপনি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে উটের দুধ পেয়ে যাবেন।
উটের দুধের চা
বাংলাদেশে বর্তমানে দুবাই থেকে উটের দুধ আমদানি করে দুধ দিয়ে চা বানানো হচ্ছে। প্রতি কাপ চা এর দাম ৪০০ টাকা।
বাংলাদেশে অনলাইনে উটের দুধ কিনা উচিত হবে কি না ?
অনলাইনে বিভিন্ন জায়গায় উটের দুধ বিক্রি হতে দেখা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে প্রতারণার একটা বড় সম্ভাবনা থেকে যায়। কেননা উটের দুধের পরিবর্তে গরুর দুধ দিয়ে আপনার আমার কাছ থেকে অনেক অনেক টাকা হাতিয়ে নেওয়া হতে পারে। তাই অনলাইনে উটের দুধ কেনার ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য কোনো অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে কেনা উচিত।
যদি আপনার কোনো আত্মীয় যদি সৌদি আরব, সোমালিয়া, কেনিয়া বা যে দেশগুলোতে উটের লালন পালন হয় সে দেশে থাকে। তবে সেখান থেকে দুধ নিতে পারেন।
অথবা বাংলাদেশের মতিঝিলে যে সকল উটের খামার রয়েছে সেখান থেকে নিতে পারেন। কেননা এখানে দুধের দাম অনেক কম এবং আপনি নিজে গিয়ে নিতে পারবেন।
উটের দুধ চিনবেন কিভাবে
উটের দুধের স্বাদ একটু নোনতা প্রকৃতির। তাই উটের দুধ খাওয়ার পর যদি আপনার কাছে মনে হয় যে নোনতা তবে কিছুটা হলে আন্দাজ করা সম্ভব যে এটা উটের দুধ।
উপসংহার
আমাদের প্রত্যেকের উচিত পরিমাণ মত উটের দুধ পান করা। আশা করি উটের দুধের উপকারিতা এবং উটের দুধ কেন এতো দামি বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পেরে উপকৃত হয়েছেন। আজকের এই লেখা সম্পর্কে আরো জানার থাকলে অনুগ্রহ করে আমাদেরকে অবগত করবেন। যদি লেখাটি আপনার কাছে ভালো লাগে তবে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন এবং বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন ধন্যবাদ।