তালাকের নিয়ম: কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম

কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম – তালাক ইসলামের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম হালাল কাজ।ইসলামে নর-নারীর বিয়ের মাধ্যমে ভালোবাসার সংসার গড়ে ওঠে। স্বামী-স্ত্রীর এই সংসারে সন্তান-সন্ততি জন্মদানের মাধ্যমে পরিবার ও বংশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিল মহব্বত না থাকলে এই সংসার ভেঙে যায়। তখন সম্পর্কের উন্নতির জন্য মাঝে মাঝে তালাক অনিবার্য হয়ে পড়ে।

কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যখন টিকিয়ে রাখা যায় না তখন নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াকেই তালাক বলে। তালাকের ঘোষণা দেওয়ার পর ইদ্দতকাল অতিবাহিত হলে তালাক হয়ে যায়।পরবর্তীতে নতুন করে বিয়েও করতে পারে।

কিন্তু তালাক দেওয়া সহজ নয়। ইসলামী আইন অনুযায়ী তালাক দিতে হলে অনেক নিয়ম কানুন মানতে হবে। তবে অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে, বাংলাদেশের তালাক তথা বিবাহ বিচ্ছেদের আইন খুবই সহজ ও সাশ্রয়ী।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে তালাকের ঘটনা বেড়েছে। তালাকের জন্য এ বিষয়ে সঠিক তথ্য প্রয়োজন। বর্তমান বাংলাদেশের আইনে কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এই আর্টিকেলটি বাংলাদেশে বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত সমস্ত আইন ও পদ্ধতি কভার করবে।

(toc) #title=(এক নজরে সম্পূর্ণ লেখা পড়ুন)

তালাক দেওয়ার নিয়ম কি?

তালাক দেওয়ার ৪ ধরনের নিয়ম আছে:

১। স্বামীর পক্ষ থেকে তালাক: ইসলামে তালাক দেওয়ার অধিকার স্বামীর সবচেয়ে বেশি। কোন কারণ ছাড়াই স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। মুখে তিন তালাক বললেও তালাক হয়। তবে অনেকেই এর সুযোগ নেয় তাই এখন মুখে তালাক বলার সাথে সাথে কোর্ট বা কাজীর শরণাপন্ন হতে হবে।

২। স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাক: ইসলামে তালাক দেওয়ার অধিকার স্ত্রীর কম। কাবিনের ১৮ নং কলামে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে বিয়ে বিচ্ছেদের ক্ষমতা দেওয়া থাকলে স্ত্রী তালাক দিতে পারবে। এটাকে তালাক-ই-তৌফিজ বলে।

৩। পারস্পারিক সম্মতিতে তালাক: এক্ষেত্রে ২ ধরনের নিয়ম আছে। (ক) খুলা (খ) মুবারত

ক) খুলা – স্ত্রী তার স্বামীকে যেকোন কিছুর বিনিময়ে তালাক দেওয়ার জন্য রাজি করালে সেটাকে খুলা তালাক বলে।

খ) মুবারত – স্বামী স্ত্রী উভয়ের পারস্পারিক সম্মতিতে তালাকের সিদ্ধান্ত নেওয়াকে মুবারক তালাক বলে।

৪। কোর্ট কর্তৃক বিচ্ছেদ: কোর্টে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করে তালাক নেওয়া।

আরো পড়ুন: মোহরানা ও কাবিন এর মধ্যে পার্থক্য

বাংলাদেশে কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম

বাংলাদেশে তালাক দেওয়ার সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হলো কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়া। কারণ কোর্ট আইন অনুযায়ী চলে। তাই কেউ তালাক দেওয়ার সময় নিয়ম লঙ্ঘন করতে পারবে না।

কোনও স্বামী বা স্ত্রী যদি কোর্টের মাধ্যমে তালাক দিতে চায় তাহলে প্রথমে একজন আইনজীবীর মাধ্যমে নোটিশ পাঠাতে হবে। দুজনের ক্ষেত্রে নোটিশ পাঠানোর নিয়ম প্রায় একই।

যদি বিয়ের সময় কাবিন নামায় উল্লিখিত ১৮ নং কলামে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার অনুমতি না দেয় তাহলে স্ত্রী ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী কোর্টে মোকদ্দমা দায়েরের মাধ্যমে তালাক নিতে পারে।

এক্ষেত্রে ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ অনুযায়ী স্ত্রী কোর্টে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করবেন। এরপর কোর্ট তালাকের ডিক্রি প্রদান করবে। ডিক্রি প্রদানের ৭ দিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি কোর্টের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান/মেয়রের কাছে পাঠানো হবে। চেয়ারম্যান/মেয়র নোটিশ পাওয়ার দিন থেকে ঠিক ৯০ দিন পর তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে।

কিন্ত ৯০ দিনের মধ্যে একটি সালিশির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে পুনরায় সংসার টেকানো যায়। যদি এর মাধ্যমে দুই পক্ষ রাজি হয় তাহলে তালাক তুলে নেওয়া যায়।

তবে ৯০ দিনের মধ্যে যদি সালিশির উদ্যোগ নেয়া না হয়, তাহলে তালাক কার্যকর হবে। এছাড়া তালাকের সময় যদি স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা থাকেন তাহলে প্রসব ও ইদ্দতকালীন সময়ের মধ্যে যেটি পরে হবে সেটির পর তালাক কার্যকর হবে। তালাক কার্যকর হওয়ার পর যে রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে ও সার্টিফিকেট উঠাতে হবে।

আরো পড়ুন: ডিভোর্সের কত দিন পর বিয়ে করা যায়

স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার নিয়ম

একজন মুসলমান পুরুষ তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে তালাকের নোটিশ দিবে। নোটিশ দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে যদি স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে মিটমাট না করেন, তাহলে তালাক কার্যকর হবে। এজন্য একজন পুরুষ বাংলাদেশের আইন অনুসারে বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিশ স্থানীয় চেয়ারম্যান/মেয়রের নিকট আবেদন করবে। চেয়ারম্যান/মেয়রের অফিসে যেদিন নোটিশটি জমা দেওয়া হবে, সেদিন থেকে ৯০ দিন গণনা শুরু হবে। কিন্তু স্ত্রী যদি গর্ভবতী থাকেন, তাহলে সন্তান জন্মদানের আগে বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হবে না।

আরো পড়ুন: divorce papers তালাক নামা ফরম ডাউনলোড

কি কি কারণে স্ত্রী তালাক দিতে পারবে

সাধারণত স্ত্রীর তালাক দেওয়ার অধিকার কম। কিন্তু নিম্নোক্ত কারণ ঘটলে স্ত্রী স্বামীকে কোর্টের মাধ্যমে তালাক দিতে পারবে।

  • ৪ বছরের বেশি সময় স্বামী নিখোঁজ থাকলে।
  • ২ বছর ধরে ভরণপোষণ না দিলে।
  • ১৯৬১ সালের পারিবারিক আইন অনুযায়ী স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত স্বামী আবার বিয়ে করলে।
  • ৩ বছর ধরে দাম্পত্য দায়িত্ব পালন না করলে।
  • ৭ বছর বা বেশি সময় স্বামী কারাদণ্ড ভোগ করলে।
  • বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন হয়ে ২ বছর পর্যন্ত তা বজায় থাকলে।
  • ২ বছর ধরে পাগল বা যৌ* নরোগের আক্রান্ত হলে।
  • নাবালিকা স্ত্রীকে বিয়ের পর ১৮ বছরে সাবালিকা হয়েও সহবাস না করলে।
  • স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করলে।
  • স্ত্রীকে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন করলে।
  • স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক থাকলে।
  • স্বামী যদি স্ত্রীকে নৈতিকতা বর্জিত জীবন যাপন করতে বাধ্য করে।
  • স্ত্রীর সম্পত্তি তার অমতে হস্তান্তর করলে।
  • স্ত্রীকে ধর্মীয় নিয়ম কানুন পালনে বাধা দিলে।
  • একাধিক স্ত্রী থাকলে যদি কুরআন অনুযায়ী ইনসাফ না করে।

তালাক নামা লেখার নিয়ম

বর্তমান সময়ে তালাক নামা হাতে লেখার কোনও নিয়ম নেই বা দরকার নেই। কারণ এখন তালাকনামা অনলাইনে পিডিএফ আকারে পাওয়া যায়। এছাড়া কাজী অফিসে তালাকনামা ফরমের প্রিন্ট কপি পাওয়া যায়।

তালাকনামা ফরমে নিচের বিষয়গুলো থাকে:

  • তালাক দেওয়ার তারিখ
  • স্বামীর নাম, পিতার নাম, ঠিকানা
  • স্ত্রীর নাম, পিতার নাম, ঠিকানা
  • কি ধরনের তালাক
  • তালাক দেওয়া জায়গার গ্রাম, থানা ও জেলার নাম
  • কারও ঘরে তালাক দিলে ঐ ব্যক্তির নাম ও পিতার নাম
  • সাক্ষীদের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা
  • রেজিস্ট্রার করার তারিখ
  • স্বামী-স্ত্রীর, সাক্ষীদের ও রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষর

তালাক দিতে কি কি কাগজ লাগে

  • বিয়ের কাবিন নামার কপি
  • দম্পতির NID এর কপি
  • দুইজন পুরুষ সাক্ষীর NID এর কপি
  • এক কপি ছবি (যদি একজন অ্যাটর্নি হলফনামা তৈরি করেন)
  • মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯৭৪-এর ৬ ধারামতে, বিয়ের কাজী নির্ধারিত ৫০০ টাকা ফি নিয়ে তালাক রেজিস্ট্রি করবেন

তালাক দিতে কি টাকা লাগে

হ্যা তালাক দিতে হলে যদি কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম অনুসরণ করা হয় তাহলে ফি দিতে হবে। কাজীর মাধ্যমেও তালাক দেওয়া হলে ফি দিতে হবে। তবে পারস্পরিক সম্মতিতে পারিবারিক বৈঠকের মাধ্যমে তালাক হলে ফি নেই। এক্ষেত্রে তালাক রেজিস্ট্রেশন ফি ৫০০ টাকা, নকল প্রাপ্তি ফি ৫০ টাকা ও যাতায়াত ভাড়া ১০ টাকা প্রতি কিলোমিটার।

আরো পড়ুন: তালাকের পর দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম

তালাকের কতদিন পর বিয়ে করা যায়

ইসলামী আইন অনুযায়ী তালাকের পর পুনরায় বিবাহের বিষয়ে নারীদের কিছুদিন সময় নিতে বলা হয়েছে। তবে যদি স্ত্রীর সাথে বিয়ের পর সহবাস না হয় তবে তালাকের সাথে সাথে বিয়ে করা যায়।

কিন্তু যদি সহবাস হয়ে থাকে বা অন্তঃসত্ত্বা হয় তাহলে নিয়মটা ভিন্ন। সেক্ষেত্রে নারী ৩ মাস বা ৯০ দিন ইদ্দত পালন বা অপেক্ষা করবে। আর বাচ্চা প্রসবের ক্ষেত্রে বাচ্চা হওয়ার পর পুনরায় বিয়ে করতে পারবে। আর পুরুষেরা তালাকের পরেই পুনরায় বিবাহ করতে পারবে। তাদের অপেক্ষা করার বিধান নেই।

লেখকের শেষ কথা

বর্তমান সময়ে সারা বাংলাদেশে তালাকের হার আকাশচুম্বী। ভবিষ্যৎ আইনি সমস্যা রোধ করতে বাংলাদেশের সহজ তালাকের পদ্ধতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা উচিত। তাই আজকের আর্টিকেলটিতে কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম নিয়ে জানিয়েছি।

About sohansumona000@gmail.com

Check Also

ট্রাফিক আইন জরিমানা মোটরসাইকেল ২০২৫: জেনে নিন সব কিছু

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে বাংলাদেশ সরকার নতুন ট্রাফিক আইন প্রবর্তন করেছেন। বিশেষ করে যারা ট্রাফিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *